সন্দীপ মহেশ্বরী এবং বিবেক বিন্দ্রা। সমাজমাধ্যমের দুই পরিচিত নাম। ততোধিক পরিচিত ইউটিউবার হিসাবে। প্রেরণামূলক কথা বলে কোটি কোটি আয় করেন দু’জনেই। সেই দুই ‘বক্তা’র কোন্দল এ বার প্রকাশ্যে। সমাজমাধ্যমে একে অপরকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে চলেছেন সন্দীপ এবং বিবেক। আর তা নিয়ে শোরগোল পড়েছে নেটদুনিয়ায়।
কিন্তু কেন দ্বন্দ্ব বেধেছে দুই ইউটিউবারের? কী নিয়ে বিতর্ক? তার আগে জেনে নিতে হবে সন্দীপ এবং বিবেক কে, কী ভাবে তাঁদের উত্থান।
সন্দীপ ভারতের এক জন অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ (মূলত প্রেরণামূলক বক্তৃতা করেন যাঁরা)। লক্ষ লক্ষ লোক অনলাইনে তাঁর কথা শোনেন।
তবে শুধু ইউটিউবার বললে তাঁর জনপ্রিয়তা বোঝানো সম্ভব নয়। তিনি এখন এক জন ‘ব্র্যান্ড’। এক স্টক ফটো সংস্থারও মালিক সন্দীপ।
কী করে ভাল থাকবেন, কী করে সফল হবেন— তার পরামর্শ দেওয়াই পেশা সন্দীপের। নেটমাধ্যমে তাঁর ভিডিয়ো মানেই লাইক, কমেন্টের ছড়াছড়ি। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে সেই সব ভিডিয়ো দেখা মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে সন্দীপের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি।
তবে ইউটিউব থেকে এক টাকাও আয় করেন না সন্দীপ। তাঁর দাবি, মানুষকে সাহায্য করা এবং কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াইয়ে ইন্ধন জোগাতেই তাঁর উদ্যোগ। আর সেই কারণেই তিনি তাঁর ইউটিউব চ্যানেল থেকে টাকা উপার্জন বন্ধ করে দিয়েছেন।
অন্য দিকে, বিবেকও ভারতের এক জন জনপ্রিয় ইউটিউবার তথা ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’। তাঁর একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
বিবেক বিন্দ্রা তার ব্যবসার ভিডিয়ো এবং প্রেরণামূলক বক্তৃতার ভিডিয়োর কারণে ইউটিউব এবং সমাজমাধ্যমে বিখ্যাত। বহু মানুষ বিবেকের ব্যবসা সম্পর্কিত উপদেশ মেনে চলেন। সন্দীপের মতো বিবেকেরও সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ২ কোটির বেশি।
এ বার দেখে নেওয়া যাক, কেন টক্কর লেগেছে দুই প্রেরণামূলক ইউটিউবারের মধ্যে। ঘটনার সূত্রপাত ১২ ডিসেম্বর। ওই দিন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ‘বিগ স্ক্যাম এক্সপোজ়ড’ শিরোনামে একটি ভিডিয়ো আপলোড করেন সন্দীপ।
সেই ভিডিয়োয় সন্দীপের শ্রোতাদের মধ্যে বসে থাকা দু’জন ছাত্র তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রতারণার কথা বলেন। তাঁরা জানান, কী ভাবে এক জন বড় ইউটিউবার তাঁদের ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ব্যবসা সংক্রান্ত কোর্স বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু সেই কোর্স কিনে তাঁরা ঠকে গিয়েছেন। কোনও লাভ হয়নি।
এ ছাড়াও, তাদের নাকি বলা হয়েছিল যে, ওই কোর্স কেনার পরে তাঁরা অর্থ উপার্জন শুরু করবেন এবং ব্যবসা করা শিখবেন। কিন্তু এতে তাঁদের কোনও লাভ হয়নি দাবি ওই দুই ছাত্রের। কোর্স কেনার পর থেকে এক টাকাও উপার্জন করতে পারেননি বলে তাঁরা জানান।
উভয় ছাত্রই সন্দীপের সেই ভিডিয়োতে দাবি করেন, ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাঁদের যে কোর্স বিক্রি করা হয়েছিল তা ইউটিউবে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
প্রতারিত বলে দাবি করা ওই দুই ছাত্র জানান, তাঁদের মতো হাজার হাজার মানুষ এই কেলেঙ্কারির শিকার। এবং অনেকে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত। যাঁরা বহু ছাত্র-ছাত্রীকে ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লক্ষ টাকার ভুয়ো কোর্স বিক্রি করেছেন। কিন্তু কোর্স কেনার পর কেউ সুফল পাননি।
এর পর সন্দীপ ওই দু’জনকে বলেন, তরুণ প্রজন্মের উচিত এই ধরনের প্রলোভন এড়িয়ে যাওয়া। এই ধরনের প্রতারকদের কথায় বিশ্বাস করা উচিত নয়। এ ছাড়াও সেই ভিডিয়োতে ওই দুই ছাত্রকে আরও অনেক পরামর্শ দেন সন্দীপ।
এর পরেই বিতর্কের সূত্রপাত। অনেক ইউটিউব ব্যবহারকারী সন্দীপের ওই ভিডিয়োর নীচে মন্তব্য করেন যে, ওই ‘প্রতারক’ ইউটিউবার আর কেউ নন, তিনি বিবেক। যদিও সেই ভিডিয়োতে বিবেকের নাম এক বারেও উল্লেখ করেননি সন্দীপ।
ভিডিয়ো আপলোড করার পরের দিনই সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করেন সন্দীপ। সেই পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বিগ স্ক্যাম এক্সপোজ়ড’ ভিডিয়োটি ইউটিউব থেকে মুছে ফেলার জন্য তাঁর কর্মীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যাঁরা এই কেলেঙ্কারিতে যুক্ত তাঁরা ওই দুই ছাত্রকেও নিজেদের বয়ান বদলের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তিনি চাপের মুখে নতি স্বীকার করবেন না বলেও স্পষ্ট করেন সন্দীপ।
এর এক দিন পর সমাজমাধ্যমে আবার একটি কমিউনিটি পোস্ট করেন সন্দীপ। সেই পোস্টে তিনি সরাসরি বিবেকের নাম নেন। তিনি লেখেন, “প্রিয় বিবেক, এক দিকে আপনি আমাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন, অন্য দিকে আপনি আপনার সাঙ্গপাঙ্গদের বার বার আমার বাড়িতে পাঠাচ্ছেন। আপনার কি মনে হয় যে, আমি আপনার হুমকিতে খুব ভয় পেয়েছি?’’
সন্দীপ সেই পোস্টে আরও লেখেন যে, ‘‘আমি নিজের সুবিধার জন্য কখনও কিছু করি না। আমি সবার উপকার করি। যা আমি চালিয়ে যাব। জনগণের কাছ থেকে নেতা-মন্ত্রীরাও ছাড় পান না, আর আপনি তো কোন ছার। এখন এটা জনগণ বনাম বিবেক বিন্দ্রা।”
এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া আসে বিবেকের কাছ থেকেও। সন্দীপের পর বিবেক তাঁর ইউটিউব চ্যানেলেও একটি কমিউনিটি পোস্ট করেন।
বিবেক সেই পোস্টে লেখেন, ‘‘আপনি আমাকে আপনার শোয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যেখানে আমি আপনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। এই ভাবে আমি আবার আপনার শোয়ে আসতে এবং সব কিছু নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে প্রস্তুত। আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। কিন্তু সত্যের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি কি আপনার আছে?
বিবেক ওই পোস্টে আরও দাবি করেন যে, সন্দীপ তাঁর নম্বর ব্লক করে দিয়েছেন এবং বিবেকের সম্পর্কে যাঁরা ভাল ভাল কমেন্ট করেছেন তা মুছে দিচ্ছেন। একই সঙ্গে বিবেক দাবি করেন, তিনি হুমকি দিতে তাঁর কর্মীদের সন্দীপের বাড়ি পাঠাননি। পাঠিয়েছিলেন পুরো বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠকের ব্যবস্থা করতে।
বিবেক এ-ও জানান, তিনি সেই সব প্রভাবশালীকেই আইনি নোটিস পাঠাচ্ছেন, যাঁরা কোনও সঠিক তথ্য ছাড়াই তাঁকে নিয়ে ভুল ভিডিয়ো তৈরি করেছেন।
সন্দীপ এবং বিবেকের সেই দ্বন্দ্বে নেটদুনিয়া দু’দলে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ইউটিউবারদের কেউ সন্দীপের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন, আবার কেউ বিবেকের হয়ে গলা উঁচু করেছেন। যদিও সন্দীপের পাল্লা এখনও পর্যন্ত ভারী। আবার অনেকে দু’জনকে এক জায়গায় বসে আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন।