ভারতের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট (এএমসিএ) তৈরির জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি। এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম দেখা যাবে স্টেলথ যুদ্ধবিমান।
রামায়ণে ইন্দ্রজিতের মেঘের আড়াল থেকে মায়াযুদ্ধের কৌশল কিংবা ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’-এ ০০৭ ব্রিটিশ এজেন্ট জেমস বন্ডের ‘স্কাইফ্লিট এস-৫৭০’। মূল লক্ষ্য একটাই— আড়াল থেকে শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ। মহাকাব্য বা রুপোলি পর্দার পরিসর ছেড়ে বাস্তবের যুদ্ধেও ব্যবহার বাড়ছে সেই যুদ্ধকৌশলের। সামরিক পরিভাষায় যে প্রযুক্তির নাম ‘স্টেলথ’।
শুরু হয়েছিল যুদ্ধবিমান দিয়ে। পরবর্তী কালে যুদ্ধজাহাজ, ডুবোজাহাজ এমনকি সামরিক হেলিকপ্টারেও ব্যবহার হচ্ছে এই প্রযুক্তি। যে প্রযুক্তির খোঁজ শুরু হয়েছিল প্রায় ছ’দশক আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। শত্রুর নজর এড়িয়ে হামলা চালানোর জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে স্বচ্ছ ফাইবারের তৈরি যুদ্ধবিমান বানিয়েছিল হিটলারের জার্মানি।
কিন্তু তাতে দু’টি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পলকা সেই যুদ্ধবিমানের অস্ত্রবহনের ক্ষমতা ছিল খুবই কম। তা ছাড়া, দিনের বেলায় উড়ানের সময় বিশেষ কোণ বরাবর সূর্যের আলো পড়লে তা ঝকমকিয়ে উঠত। নজর পড়ে যেত সহজেই। ফলে নাৎসি একনায়কের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
ঘটনাচক্রে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই শত্রুপক্ষের যুদ্ধবিমান চিহ্নিত করার জন্য রাডারের ব্যবহার শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয়, রাডার-নজরদারি ফাঁকি দেওয়ার প্রযুক্তির সন্ধান। এ ক্ষেত্রেও পথপ্রদর্শক ছিল জার্মানি। সে দেশের অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারেরা পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, রাডারের ছুড়ে দেওয়া রেডিয়ো তরঙ্গ বিশেষ করে বিমানের মূল দেহে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।
এর পর বিমানের দেহ ছোট করে ডানার অংশ দীর্ঘ করার চেষ্টা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে রাডার নজরদারি ফাঁকি দেওয়ার জন্য ‘হর্টেন ২২৯’ নামে একটি যুদ্ধবিমান বানিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু যুদ্ধে তা ব্যবহারের আগেই হিটলারের পরাজয় ঘটে।
বস্তুত, ছ’দশক পরেও শত্রুপক্ষের বিমান বা যুদ্ধজাহাজ চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত রাডারের মূল প্রযুক্তি প্রায় একই রয়েছে। যে এলাকা থেকে জল বা আকাশপথে শত্রুসেনার আগ্রাসনের আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে নির্দিষ্ট সময় অন্তর রেডিয়ো তরঙ্গ ছুড়ে দেয় রাডার। যুদ্ধবিমান বা জাহাজের ধাতব দেওয়ালে সেই নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের রেডিয়ো তরঙ্গ ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলেই কেল্লা ফতে। নিমেষে হিসাব করে নেওয়া যায় সেই বিমান বা জাহাজের অবস্থান, আকার, অভিমুখ এবং গতিবেগ।
অর্থাৎ, রাডারের নজরদারি এড়াতে হলে বাঁচতে হয় সেই রেডিয়ো তরঙ্গ থেকে। রাডার প্রতিরোধী স্টেলথ প্রযুক্তির লক্ষ্য একটাই— বিমান বা জাহাজের গায়ে ধাক্কা খাওয়া রেডিয়ো তরঙ্গকে ঠিক ভাবে রাডারের কাছে ফিরতে না দেওয়া।
এর জন্য রেডিয়ো তরঙ্গকে শুষে নেওয়া বা দিগ্ভ্রান্ত করার পদার্থ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ ধাতুশঙ্কর এবং কার্বন ফাইবারের তৈরি স্টেলথ যুদ্ধবিমান কিংবা ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ার জাতীয় স্টেলথ যুদ্ধজাহাজ সেই কাজ করতে পারে। যা সাধারণ ধাতুতে তৈরি যুদ্ধবিমানের পক্ষে সম্ভব নয়।
পাশাপাশি, রেডিয়ো তরঙ্গকে শুষে নেওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের রঙর প্রলেপ দেওয়া হয়। যার পোশাকি নাম, ‘র্যাম’ (রেডিয়ো ওয়েভ অ্যাবসরবেন্ট মেটেরিয়াল)। আকাশ এবং জলের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ড্যাজেল ক্যামোফ্ল্যাজের’বৈশিষ্ট্যও থাকে ওই রঙে।
এর ফলে উপস্থিতি চিহ্নিত করা গেলেও চলন্ত অবস্থায় স্টেলথ যুদ্ধবিমান বা জাহাজের গতিবেগ বা অভিমুখ চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। শত্রুর বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বা টর্পেডোর লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
স্টেলথ যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজবাহিত বোমা, ক্ষেপণাস্ত্রেও থাকে ‘র্যাম’-এর আবরণ। অনেক ক্ষেত্রে সেই অস্ত্রসম্ভার রাখা হয় বিশেষ প্রকোষ্ঠে। যার নাম ‘স্টেলথ বক্স’।
রাডারের নজরদারি এড়ানোর জন্য স্টেলথ যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধজাহাজের আকার এবং আকৃতিরও পরিবর্তন করা হয়। যেমন, গাণিতিক আঁক কষে স্টেলথ যুদ্ধবিমানের দেহে বানানো হয় নির্দিষ্ট কিছু কৌণিক অয়বব। সেই অংশগুলিতে ধাক্কা খেয়ে রেডিয়ো তরঙ্গ ঠিক ভাবে রাডারের কাছে না ফিরে অন্য অভিমুখে ছিটকে যায়।
যদি রেডিয়ো তরঙ্গের কিছু রাডারে ফিরেও আসে, তবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি, চিহ্নিত বস্তুটি যুদ্ধবিমান না কি কোনও পাখি, তা বোঝাও কঠিন হয়ে পড়ে।
শুধু রাডার নয়। আধুনিক যুদ্ধে আকাশ এবং জলপথে প্রতিপক্ষের গতিবিধি নজরদারির বড় হাতিয়ার হল ‘ইনফ্রারেড সার্চ অ্যান্ড ট্র্যাকিং সিস্টেম’। বিমান বা যুদ্ধজাহাজের ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপকে ‘থার্মাল ভিশন’ প্রযুক্তির সাহায্যে চিহ্নিত করা হয় এই পদ্ধতিতে।
সাধারণ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন থাকে নীচে। স্টেলথ যুদ্ধবিমানে থাকে উপরের অংশে। ফলে ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ পুরোপুরি প্রশমন করা সম্ভব হয় না। এর জন্য হিমশীতল হাওয়া দিয়ে ইঞ্জিন নির্গত তাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়। স্টেলথ ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ারের ইঞ্জিনও তুলনামূলক ভাবে খোলের অনেকটা ভিতরে থাকে।