রুশদের ক্ষেপণাস্ত্রহানা ঠেকাতে এ বার নয়া অস্ত্র হাতে পাবে ইউক্রেন। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হোক বা ড্রোনের আক্রমণ— সবই ভোঁতা করে দিতে পারে তাদের অস্ত্রভান্ডারে যোগ হচ্ছে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র।
গত ডিসেম্বরে ইউক্রেনকে এই অস্ত্রসাহায্যের কথা ঘোষণা করেছিল আমেরিকার জো বাইডেন সরকার। এ বার জার্মানিও একই পথে এগোবে বলে সোমবার জানিয়েছেন সে দেশের চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলস। কিন্তু কতটা ক্ষমতাধর এই অস্ত্র?
ডিসেম্বরে আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। তাঁর সফরের আগে ২১ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনের ঘোষণা ছিল, জ়েলেনস্কির বাহিনীকে ১৮৫ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য দেওয়া হবে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তার মধ্যে ছিল প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র বা প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের দাবি, ইউক্রেনের হাতে প্যাট্রিয়ট তুলে দিতে গোড়ায় দোটানায় ছিল জার্মানি। এর জেরে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে নেটো সরাসরি জড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ।
তবে বাইডেনের সঙ্গে ওলাফের বৈঠকের পর ইউক্রেনকে অস্ত্রসাহায্যের বিষয়ে ঐকমত্য হয়। একটি যৌথ বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন দুই রাষ্ট্রনেতা।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ডিসেম্বরের শেষ দিকে ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার কথা জানিয়েছিল আমেরিকা। আমেরিকার মতো ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট দেবে জার্মানিও।’’
প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র কী? ‘প্যাট্রিয়ট’ শব্দটি আসলে ‘ফেজ়ড অ্যারে ট্র্যাকিং রাডার ফর ইন্টারসেপ্ট অন টার্গেট’-এর সংক্ষিপ্তকরণ। রয়টার্স জানিয়েছে, এই সিস্টেমটির মূল লক্ষ্য স্থলভাগ থেকে আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্রহানা ঠেকানো।
রেথিয়ন টেকনোলজ়িস কর্পোরেশনের তৈরি এই প্যাট্রিয়ট সিস্টেমকে আমেরিকার অস্ত্রভান্ডারের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মধ্যে অন্যতম বলে ধরা হয়।
অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হাতে প্যাট্রিয়ট এলেও নব্বইয়ের দশক থেকেই একে কাজে লাগিয়েছে আমেরিকা। আমেরিকার দাবি, ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরব, কুয়েত এবং ইজ়রায়েলকে রক্ষা করতে প্যাট্রিয়টের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
২০০৩ সালে ইরাকের হামলার সময়ও আমেরিকার তুরুপের তাস ছিল প্যাট্রিয়ট। আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে স্কাড নামে যে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে হাতিয়ার করেছিল সাদ্দাম হুসেনের বাহিনী, সেগুলিকে আকাশপথে চিহ্নিত করে ধ্বংস করত সাঁজোয়া গাড়িতে থাকা এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা।
রয়টার্স জানিয়েছে, প্যাট্রিয়টের মতো চলমান ব্যবস্থাটিতে রয়েছে একটি শক্তিশালী রাডার, কন্ট্রোল স্টেশন, পাওয়ার জেনারেটর, ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর লঞ্চ স্টেশন-সহ অন্যান্য সহযোগী গাড়ি।
প্যাট্রিয়টের ব্যবস্থার মধ্যে কোন ধরনের ইন্টারসেপ্টর লাগানো রয়েছে, তার উপর এর কার্যকারিতা নির্ভর করে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। যেমন, পিএসি-২ ইন্টারসেপ্টরে ব্লাস্ট-ফ্র্যাগমেন্টেশন ওয়ারহেড রয়েছে। অন্য দিকে, পিএসি-২ ক্ষেপণাস্ত্রে আরও অত্যাধুনিক ‘হিট-টু-কিল’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
২০১৫ সালে নেটো জানিয়েছিল, প্যাট্রিয়টের রাডারের পরিসীমা ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি।
এক-একটি প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের খরচও চোখ কপালে তোলার মতো। আমেরিকার সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজ়িক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ় জানিয়েছে, প্যাট্রিয়টের একটি নতুন ব্যাটারির দাম ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে ৪০ কোটি ডলার মূল্যের সিস্টেম এবং ৬৯ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র। যা ব্যাটারির মধ্যে থাকে।
বিশ্বে একমাত্র আমেরিকার কাছেই যে এই অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে, তা অবশ্য নয়। রয়টার্সের দাবি, এই মুহূর্তে বিশ্বের ১৮টি দেশের কাছে প্যাট্রিয়ট রয়েছে। মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইরানের আক্রমণের আশঙ্কায় নাকি প্যাট্রিয়টের চাহিদা তুঙ্গে উঠেছে।
রয়টার্স সূত্রে খবর, আমেরিকার-সহ বিশ্বের ১৮টি দেশের জন্য ২৪০টিরও বেশি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম তৈরি করেছে রেথিয়ন। ওই সংস্থার দাবি, ২০১৫ সাল থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ১৫০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রর আক্রমণকে ভোঁতা করতে সক্ষম হয়েছে প্যাট্রিয়ট।
রুশদের আক্রমণ ঠেকাতে কি সত্যিই কার্যকরী হবে প্যাট্রিয়ট? ইউক্রেন সরকার আগেই জানিয়েছিল, আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের মাধ্যমে রুশদের মুহুর্মুহু আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গ়ড়ে তুলতে এ ধরনের আরও অস্ত্র প্রয়োজন।
রয়টার্স জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ইউক্রেনীয়দের এক জোড়া ‘ন্যাশনাল অ্যাডভান্সড সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেমস’ (নাসামস) দিয়ে সাহায্য করেছে আমেরিকা। প্যাট্রিয়ট হাতে এলে স্বাভাবিক ভাবেই ইউক্রেনীয়দের ক্ষমতা বাড়বে।
রয়টার্স জানিয়েছে, যুদ্ধবিমান এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি রাশিয়ার কামিকাজ়ে ড্রোনকেও ধ্বংস করতে সক্ষম প্যাট্রিয়ট। প্রসঙ্গত, কামিকাজ়ে ড্রোনের মাধ্যমেই ইউক্রেনের বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোয় আঘাত হেনেছে রুশ সেনাবাহিনী।
কোটি কোটি ডলারের প্যাট্রিয়ট দিয়ে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা গেলে বহু ইউক্রেনীয়ের প্রাণরক্ষাও হবে বলে মত সে দেশের সরকারের। যদিও তাতে প্রায় ১১ মাস ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরবে না বলেও মনে করেন তাঁরা। কারণ, প্যাট্রিয়ট মূলত আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়।
প্যাট্রিয়ট নিয়ে বড়সড় ঘোষণা করলেও এই মুহূর্তে তা হাতে এলেও কাজে লাগাতে পারবে না ইউক্রেন। কারণ, কয়েক মাস প্রশিক্ষণের পরেই একে চালাতে পারবেন ইউক্রেনীয় সেনারা।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আধিকারিকেরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, প্যাট্রিয়ট সিস্টেমকে প্রথমে জার্মানিতে পাঠানো হবে। সেখানেই এই সিস্টেম চালানোর প্রশিক্ষণ নেবে ইউক্রেনীয় সেনা।
প্যাট্রিয়ট চালানোর কাজে দক্ষ হতে মাসের পর মাস কেটে যেতে পারে। একটি প্যাট্রিয়টকে চালনা করতে একাধিক সেনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানিয়েছে রয়টার্স।
ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, রুশ আক্রমণ ঠেকাতে দেশের কোন প্রান্তে অত্যাধুনিক প্যাট্রিয়ট রাখা হবে সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। কেন?
রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়া আগেই হুমকি দিয়েছে, প্যাট্রিয়টকে ধ্বংস করাও এ বার তাদের সেনাবাহিনীর লক্ষ্য হবে।