এক দেশ, এক ভোট। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আপাতত এই নীতিকেই কার্যকর করতে তৎপর হয়েছে কেন্দ্রের সরকার। নীতি কার্যকর কী ভাবে হবে, কোন পথে সঠিক দিশা মিলতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ইতিমধ্যেই আলোচনা সেরেছে কেন্দ্র। ইতিমধ্যেই দিশা খুঁজে পেতে একটি কমিটিও গঠন করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। তবে বিরোধীদের অভিযোগ, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে দেওয়ার ‘সুপরিকল্পিত’ ছক এই নীতি।
১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংসদে বিশেষ অধিবেশনের ডাক দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, সেই অধিবেশনেই ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির বিল পেশ করতে পারে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীর হঠাৎ করে ডাকা এই অধিবেশনও তেমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কিন্তু কী এই ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি? এই নীতি প্রণয়নের লাভ এবং ক্ষতিই বা কী হতে পারে? আপাতত এই সব প্রশ্নই উঠছে দেশবাসীর মনে। ‘এক দেশ, এক ভোট’ বলতে বোঝায়, সারা দেশে একযোগে নির্বাচন। অর্থাৎ, সারা ভারত জুড়ে লোকসভা এবং সমস্ত রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে।
বর্তমানে দেশের সাধারণ নির্বাচন এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন আলাদা আলাদা সময়ে হয়। ক্ষমতাসীন সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হলে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতিতে সেই হিসাব বদলে যাবে।
রাজনীতির কারবারিদের মতে, দেশে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে হলে তার কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে।
‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির সমর্থনে ভোটপণ্ডিতদের একাংশ বলেন, আলাদা আলাদা নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক দলগুলি এবং নির্বাচন কমিশনের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, তা আর হবে না। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোট ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। আলাদা আলাদা বিধানসভা নির্বাচনের আবার আলাদা আলাদা হিসাব রয়েছে। কিন্তু এই নীতি কার্যকর হলে, সেই খরচ ঠেকানো যাবে বলেই অনেকের দাবি।
উপরন্তু, ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির সমর্থকদের যুক্তি, এই নীতি দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াবে। আলাদা আলাদা ভোটের সময় সরকারি কর্মীদের নির্বাচনী দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে প্রশাসনিক কাজ বিঘ্নিত হয়। জনসাধারণের সমস্যার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু দেশে একসঙ্গে বিধানসভা এবং লোকসভা ভোট একসঙ্গে সেরে ফেলা গেলে সেই সমস্যার সুরাহা হবে বলে মত সমর্থকদের।
‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে ভোটের আদর্শ আচরণ বিধির জন্য বার বার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ থমকে থাকবে না বলেও অনেকের মত। বর্তমানে, নির্বাচন ঘোষিত হলে তার কিছু আগে থেকেই আদর্শ আচরণবিধি জারি করা হয়। সেই সময়ে জনকল্যাণের জন্য নতুন প্রকল্প চালু করা যায় না। আর তাই এই নতুন নীতি চালু হলে সেই সব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না বলে সমর্থকদের দাবি।
পাশাপাশি আইন কমিশনের দাবি, সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রবণতা এবং ভোটের হার বাড়বে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এক বার ভোট দেওয়া সুবিধাজনক হবে বলেও ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির সমর্থকরা মনে করছেন।
অন্য দিকে, এই নীতির বিরোধিতা করা অন্য অংশের মতে, লোকসভার এবং বিভিন্ন বিধানসভার ভোট একসঙ্গে করতে হলে সাংবিধানিক সংশোধনী প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পাশাপাশি অন্যান্য সংসদীয় পদ্ধতিতেও সংশোধন করতে হবে।
আঞ্চলিক দলগুলির নেতৃত্বের দাবি, একযোগে নির্বাচন হলে প্রান্তিক মানুষের দাবিদাওয়া সে ভাবে গুরুত্ব পাবে না। জাতীয় বিষয়গুলিই আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠবে। একসঙ্গে ভোট হলে নির্বাচনী ব্যয় এবং কৌশলের ক্ষেত্রেও তারা জাতীয় দলগুলির সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে না বলে তাঁদের দাবি।
২০১৫ সালে আইডিএফসি ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ভোটারদের বিধানসভা এবং লোকসভায় বিজয়ী দল বা জোটকে বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ।
‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি প্রণয়ন করা হলে তা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী হবে বলেও রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মত।
১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে হত। তবে ১৯৬৮ এবং ’৬৯ সালে কয়েকটি রাজ্যের সরকার এবং ১৯৭০ সালে কেন্দ্রের সরকার ভেঙে গেলে পরিস্থিতি বদলে যায়। ধীরে ধীরে সাধারণ নির্বাচন এবং বিধানসভা নির্বাচন আলাদা হতে শুরু করে।
১৯৮৩ সালে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন আবার একসঙ্গে সেরে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এই নীতির বিরোধিতা করে। ১৯৯৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্টেও একযোগে নির্বাচনের জন্য জোর দেওয়া হয়েছিল।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী হন মোদী। এর পর ২০১৬ সালে ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি নিয়ে নড়়েচড়ে বসে কেন্দ্রের সরকার। ২০১৭ সালে নীতি আয়োগের তরফে একযোগে নির্বাচনের প্রস্তাবের উপর একটি সুপারিশপত্র তৈরি করা হয়।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী পদে বসার মাত্র এক মাস পরে, মোদী ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি নিয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানদের বৈঠক করার ডাক দেন।
কংগ্রেস, তৃণমূল, বিএসপি, এসপি এবং ডিএমকে-সহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল এই বৈঠকে যোগ দেয়নি। তবে আম আদমি পার্টি, তেলুগু দেশম পার্টি এবং ভারত রাষ্ট্র সমিতি (তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি) সেই বৈঠকে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল।
২০২২ সালে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্র জানিয়েছিলেন, লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং সক্ষম। তবে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, এই নীতি বাস্তবায়িত করতে হলে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
২০২২-এর ডিসেম্বরে, আইন কমিশন দেশে একযোগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাবে রাজনৈতিক দল, ভারতের নির্বাচন কমিশন, আমলা, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়েছিল।
অন্য দিকে, বিরোধী দলগুলি এই নীতির বিরোধিতায় নেমেছেন। বৃহস্পতিবার, শিবসেনা সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী বলেন, ‘‘যদি অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ না করে আইন কার্যকর করা হয়, তা হলে আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব।’’ আপ সাংসদ সঞ্জয় সিংহের দাবি, বিজেপি তিনটি রাজ্যের নির্বাচনে হেরে ভয় পেয়েছে। সেই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার একযোগে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে বলেও তাঁর দাবি।
মুম্বইয়ে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধী নেতারা। তাঁদের মতে, এই নীতি নিয়ে মোদী সরকার ঘুরপথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ধাঁচের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সংসদীয় গণতন্ত্রিক ভাবনার পরিপন্থী বলেও বিরোধী নেতৃত্বের অভিযোগ।
বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির আশঙ্কা, ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে লোকসভার নির্বাচনের প্রভাব বিধানসভাগুলিতে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, সাংসদ এবং বিধায়ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেটুকু বৈচিত্রের সম্ভাবনা রয়েছে, বিজেপির আগ্রাসী প্রচারের মুখে তা ভেঙে পড়বে।
‘এক ভোট’ ব্যবস্থা চালুর পরে কেন্দ্রে বা কোনও রাজ্যে পাঁচ বছরের আগেই নির্বাচিত সরকার পড়ে গেলে কী হবে, প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। এরই পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লষকদের একাংশ মনে করছেন, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশল থেকেই ‘এক দেশ এক ভোট’ পদ্ধতি কার্যকর করতে চাইছে বিজেপি। তাদের উদ্দেশ্য, শুধু লোকসভা ভোট হলে বিরোধী দলগুলির পক্ষে আসন সমঝোতা করা সহজ হবে। কিন্তু একই সঙ্গে বিধানসভা ভোট জুড়ে দিতে পারলে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগী আঞ্চলিক দলগুলির বিরোধ অনিবার্য।
বিরোধীদের একাংশের আশঙ্কা, পরবর্তী পর্যায়ে এই নীতিতে হেঁটে রাজ্য নির্বাচন কমিশনগুলিকে কার্যত ক্ষমতাহীন করে দিয়ে পঞ্চায়েত-পুরসভা ভোটকেও এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ঘটনাচক্রে, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ সংক্রান্ত মামলায় ধাপে ধাপে উপত্যকার পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভার ভোটের আয়োজনের কথা বলেছে মোদী সরকার।
সরকারি সূত্রে খবর, ‘এক দেশ এক ভোট’ পদ্ধতি করতে সংবিধানের বেশ কিছু অনুচ্ছেদ বদলের প্রয়োজন হতে পারে। ৮৩ নম্বর অনুচ্ছেদে সংসদের দুই কক্ষের মেয়াদের কথা বলা হয়েছে। ৮৫ নম্বর অনুচ্ছেদে লোকসভা ভেঙে দেওয়ার নিয়ম নথিবদ্ধ রয়েছে। ১৭২ নম্বরে রয়েছে রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদের কথা। ১৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার নিয়ম নথিবদ্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ৩৫৬ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি সংক্রান্ত বিধি এবং ১৯৫১ সালের ভারতীয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইনও কিছু সংশোধন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।