গাজ়ার আল-আহলি আরব হাসপাতালে হামলা চালানোর জন্য সরাসরি হামাসকে নয়, ইজ়রায়েলি সেনা দায়ী করছে আর এক ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠনকে।
সংগঠনটির গোড়াপত্তন বেশ কয়েক দশক আগে হলেও চলতি সংঘাতে এই প্রথম ইজ়রায়েলের তরফে তাদের নিন্দা করা হল। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তো বটেই, ভারতে নিযুক্ত ইজ়রায়েলি রাষ্ট্রদূত নাওর গিলোন ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠনটিকে গাজ়ার হাসপাতালে হামলার জন্য দায়ী করেছেন।
সংগঠনটির নাম প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ (পিআইজি)। চলতি সংঘাতে হামাসের সহযোগী হিসাবে লড়াই করছে এই সংগঠনটিও। তবে বহু ক্ষেত্রেই প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সঙ্গে অমিল রয়েছে তাদের। আবার বেশ কিছু বিষয়ে রয়েছে মিলও।
হামাস এবং ইসলামিক জেহাদের মধ্যে প্রধান মিল হল, দু’টি গোষ্ঠীই ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের উচ্ছেদসাধনের জন্য লড়াই করছে বলে দাবি করে। তবে হামাস সশস্ত্র সংগঠন চালানোর পাশাপাশি গাজ়া ভূখণ্ডে একাধিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাজও করে।
প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ স্রেফ ‘লড়াইয়ের মাধ্যমে ইজ়রায়েলকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছতে’ চায়। অন্য দিকে, ২০০৬ সালে প্যালেস্তাইনের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয় হামাস। গৃহযুদ্ধের পর ২০০৭ সালে গাজ়ার একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে তারা।
হামাস এবং প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ তৈরি হওয়ার নেপথ্যেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দুই প্রেক্ষাপট। মূলত মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখা হিসাবে ১৯৮৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে হামাস।
অন্য দিকে, মুসলিম ব্রাদারহুড প্যালেস্তিনীয় সঙ্কটের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ, এমনটা ধরে নিয়েই আত্মপ্রকাশ করে প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ। এই গোষ্ঠীর দুই প্রতিষ্ঠাতা হলেন ফাথি শাকাকি এবং আবাদাল-আজ়িজ আওয়াদা।
মিশরে পড়ার সময়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের সংস্পর্শে আসেন শাকাকি এবং আওয়াদা। সত্তরের দশকে ব্রাদারহুড ছেড়ে প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ নামের সংগঠন তৈরি করেন তাঁরা।
সংগঠনটির দুই প্রতিষ্ঠাতাই বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আয়াতোল্লা রুহোল্লা খোমেনেই পরিচালিত ইরানি বিপ্লবের দ্বারা। যদিও ইরান কোনও দিনই বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদকে।
তার কারণ শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরান দীর্ঘ দিন ধরেই প্যালেস্তাইনে নিজেদের আদর্শগত প্রভাব বিস্তার করাতে পারেনি। তার কারণ প্যালেস্তাইনের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষই সুন্নি।
যদিও ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর তেহরান মিশর, তিউনিসিয়া, সুদান এবং প্যালেস্তাইনে নিজেদেরকে গোঁড়া এবং রক্ষণশীল মতাদর্শ প্রচারে অনেকটা অগ্রসর হয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়।
আমেরিকা মনে করে যে হামাস এবং লেবাননের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হেজ়বোল্লার মতোই ইসলামিক জেহাদ সংগঠনটিকেও অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে ইরান। ইজ়রায়েল গাজ়ার দখল নেওয়ার পর অবশ্য সংগঠনটির সব সদস্যকে লেবাননে চলে যেতে বাধ্য করে।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতরের দাবি অনুযায়ী, লেবাননে যাওয়ার পর প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদকে আরও বেশি পরিমাণে অর্থ এবং অস্ত্র পাঠাতে থাকে ইরান। সংগঠনটিকে মদত দেওয়ার জন্য আমেরিকা অভিযোগের আঙুল তুলেছে সিরিয়ার দিকেও।
পেন্টাগনের বক্তব্য, সিরিয়ার শাসক বাশার আল-আসাদের সরকার দামাস্কাসকে প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ-এর ‘স্বর্গরাজ্য’ করে তুলেছে। অথচ ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠনটির বিরুদ্ধে হাজার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনও পদক্ষেপ করেনি।
১৯৮১ সালে মিশরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আনওয়ার সাদাত খুন হওয়ার পর নীলনদের দেশ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে প্যালেস্তাইনে ঘাঁটি বানায় প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ।
গাজ়া ভূখণ্ডে হামাসের সঙ্গে সহাবস্থান করলেও প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ বহু ক্ষেত্রেই স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করে থাকে। হামাস ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে অনেক সাবধানে পা ফেলার পক্ষপাতী। কিন্তু ইসলামিক জিহাদ সংগঠনটির ইজ়রায়েল-বিরোধী অবস্থান আরও বেশি কড়া এবং চরম।
সাম্প্রতিক অতীতে ইজ়রায়েল-হামাস সংঘাতে বহু ক্ষেত্রেই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ। কৌশল হিসাবেই কিছুটা নেপথ্যে থেকেছে হামাস। আমেরিকার তরফে ‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’-এর তকমা পাওয়া ইসলামিক জিহাদ ১৯৮৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বহু আত্মঘাতী হামলায় ইজ়রায়েলিদের হত্যা করেছে।
তবে বর্তমান সংঘাতে যাবতীয় মতফারাক দূরে রেখে হামাসের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালাচ্ছে ইসলামিক জিহাদ। তেল আভিভের বক্তব্য, সংগঠনটি ক্ষেপণাস্ত্র চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় গাজ়ার হাসপাতালে বিস্ফোরণ হয়েছে। ইসলামিক জিহাদের তরফে এই বিষয়ে এখনও কিছু বলা না হলেও ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে হামাস, এমনকি প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষও।