যুদ্ধ চলছে ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র জঙ্গি বাহিনী হামাসের মধ্যে। ইতিমধ্যেই এই সংঘাতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। ইজ়রায়েলে ঢুকে বহু সাধারণ মানুষকে নৃশংস ভাবে খুন করার অভিযোগ উঠেছে হামাস বাহিনীর বিরুদ্ধে। পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে ইজ়রায়েলও। এখনও পর্যন্ত সব মিলিয়ে দু’পক্ষের সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন।
এখন শুধু হামাস বাহিনীকে ঠেকাতে হচ্ছে না, হামাসের দোসর হয়েছে লেবাননের জঙ্গি গোষ্ঠী হেজ়বুল্লা। হামাসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করার কথা জানিয়েছে তারা। ইজ়রায়েলের উত্তর সীমান্তে ইতিমধ্যেই সে দেশের বাহিনীর সঙ্গে হেজ়বুল্লা গোষ্ঠীর সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।
হেজ়বুল্লার তরফে আমেরিকাকেও সাবধান করা হয়েছে। হেজ়বুল্লার বার্তা, প্যালেস্তাইনকে ইউক্রেন ভাবলে চলবে না। আমেরিকা-সহ ইজ়রায়েলের সমর্থক দেশগুলিকেও লেবাননের জঙ্গি গোষ্ঠী এই বার্তা দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি হামাসের হাতে আমেরিকার বহু নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, এমনটা দাবি করে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জো বাইডেনের দেশ। ইজ়রায়েলে যুদ্ধজাহাজ এবং অন্যান্য সামরিক সহায়তা পাঠানোর কথাও ঘোষণা করেছে ওয়াশিংটন। আর তার পরেই ইজ়রায়েল-হামাস সংঘাতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ করা নিয়ে এমন মন্তব্য করেছে হেজ়বুল্লা গোষ্ঠী।
একটি বিবৃতি জারি করে লেবাননের ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘প্যালেস্তাইনকে ইউক্রেন ভাবলে ভুল করবে অন্যেরা। বাইরের কোনও শক্তি ইজ়রায়েল এবং হামাসের সংঘাতে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিলে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী মঙ্গলবার জানিয়েছে, লেবাননের ভূখণ্ড থেকে এক ডজনেরও বেশি রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে ইজ়রায়েলে। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সোমবার জানান, হেজ়বুল্লাকে ঠেকাতে উত্তর সীমান্তকে শক্তিশালী করার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কী এই হেজ়বুল্লা? তা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে বহু প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে।
হেজ়বুল্লা কথার অর্থ ‘আল্লা বা ঈশ্বরের দল’। ইরানের মদতপুষ্ট লেবাননের শিয়া মুসলিমদের এই দল বিভিন্ন সময়ে চর্চায় থেকেছে।
১৯৮০-র দশকে লেবাননের গৃহযুদ্ধের মধ্যেই হেজ়বুল্লা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। ১৯৯২ সাল থেকে এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন ধর্মগুরু এবং রাজনৈতিক নেতা হাসান নাসরাল্লাহ।
রাজধানী বেইরুট-সহ লেবাননের যে সমস্ত জায়গায় শিয়া মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, সেই জায়গাগুলি হেজ়বুল্লার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আমেরিকা, ইজ়রায়েল-সহ একাধিক দেশ হেজ়বুল্লাকে জঙ্গি সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
১৯৭৮ সালে সেনা পাঠিয়ে দক্ষিণ লেবাননের দখল নিয়েছিল ইজ়রায়েল। নিউইয়র্ক সিটির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’ অনুযায়ী, তার পর থেকেই ইজ়রায়েলের সঙ্গে লেবাননের মন কষাকষির সূত্রপাত। হিজ়বুল্লা গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার পর তারাও ইজ়রায়েলকে ‘প্রধান শত্রু’ বলে মনে করে।
‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’ জানিয়েছে, ২০০০ সালে ইজ়রায়েল আনুষ্ঠানিক ভাবে দক্ষিণ লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহারের পরেও হেজ়বুল্লার সঙ্গে এদের সংঘাত লেগেই রয়েছে। বিক্ষিপ্ত ভাবে ইজ়রায়েলের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে সংঘর্ষ চলছে এই গোষ্ঠীর। ২০০৬ সালে ইজ়রায়েলের সঙ্গে এক মাস ধরে যুদ্ধ চলেছিল হেজ়বুল্লার।
বিদেশে ইজ়রায়েলিদের উপর একাধিক হামলার জন্য বার বার হেজ়বুল্লাকে দায়ী করা হয়েছে। ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’-এর দাবি, হেজ়বুল্লা গোষ্ঠী এখন আর শুধু লেবাননে সীমাবদ্ধ নেই। আফ্রিকা, আমেরিকা এবং এশিয়াতেও তাদের সমর্থকেরা রয়েছেন।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় ইরান ও রাশিয়ার পাশাপাশি হেজ়বুল্লা গোষ্ঠীও সিরিয়া সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিল।
রাজনৈতিক দল হিসাবে লেবাননের গত বছরের নির্বাচনে ১২৮ সদস্যের আইনসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে হেজ়বুল্লা।
হামাসের পাশাপাশি হেজ়বুল্লাও ইজ়রায়েলের অস্তিত্ব মানতে অস্বীকার করে। এই দুই গোষ্ঠীকেই জঙ্গি গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করেছে ইজ়রায়েল, আমেরিকা এবং বন্ধু রাষ্ট্রগুলি।
হেজ়বুল্লা গোষ্ঠী ইসলামের সিয়া শাখার অন্তর্ভুক্ত হলেও হামাস গোষ্ঠী সুন্নি শাখার অন্তর্ভুক্ত। হামাস গাজ়ার ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য দিকে, হেজ়বুল্লা রয়েছে লেবাননের বিভিন্ন অংশে।
এই দুই গোষ্ঠীকেই দীর্ঘ দিন ধরে ইরান সমর্থন করে আসছে বলে জল্পনা রয়েছে। তেহরান এই দুই গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ করার পাশাপাশি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয় বলেও ইজ়রায়েলের দাবি।
মঙ্গলবার ইজ়রায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেন, ‘‘বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসের যে অক্টোপাস রয়েছে ইরান তার প্রধান। সেই অক্টোপাসের একটি হাত হেজ়বুল্লা এবং অন্যটি হামাস।’’
ইজ়রায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী সোমবার জানিয়েছে, তারা লেবানন থেকে ইজ়রায়েলে অনুপ্রবেশকারী অনেক জঙ্গিকে খতম করেছে। মঙ্গলবার লেবাননের ভূখণ্ড থেকে উৎক্ষেপণ করা প্রায় ১৫টি রকেটের যথাযথ জবাব দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে ইজ়রায়েল।