বক্স অফিসে এখন ‘পাঠান’ ঝড়। মুক্তি পাওয়ার ২২ দিনের মাথাতেই ৫০০ কোটি টাকার ক্লাবে নাম লিখিয়ে ফেলেছে শাহরুখ খানের ছবিটি। দেশ এবং বিদেশ জুড়ে ৯৬৩ কোটি টাকা উপার্জন করে ফেলেছে ২২৫ কোটি টাকা বাজেটের ছবিটি। খুব শীঘ্রই ১০০০ কোটির ক্লাবে নাম লিখিয়ে ফেলবে বলে আশা রাখছেন বক্স অফিস বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এই টাকা কী ভাবে দেশ জুড়ে সংগ্রহ করা হয়, প্রেক্ষাগৃহের টিকিটঘর থেকে এই টাকা শেষ পর্যন্ত ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটারদের হাতে কী ভাবে পৌঁছয়— রইল ভারতের বক্স অফিসের যাবতীয় খুঁটিনাটি।
১৮৭৬ সালে ‘বক্স অফিস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। গোড়ার দিকে ‘বক্স অফিস’ বলতে থিয়েটারে ‘বক্স’ বিক্রির পরিমাণ বা ব্যক্তিগত আসন বোঝানো হত।
কিন্তু ১৯০৪ সালের পর ‘বক্স অফিস’ শব্দটির অর্থ বদলে যায়। তার পর থেকে বক্স অফিসের মাধ্যমে কোনও ছবির মোট ব্যবসার পরিমাণকে নির্দেশ করা হয়ে থাকে।
কোনও প্রযোজনা সংস্থার ছবি মুক্তি পাওয়ার পর তা বাণিজ্যিক ভাবে সফল হল কি না, তা নির্ধারণ করা হয় বক্স অফিসে তা ‘হিট’ হল না ‘ফ্লপ’ করল তার উপর নির্ভর করে।
বক্স অফিসের ওঠানামার খেলার দিকে লক্ষ করেই অধিকাংশ সময় দর্শক সিদ্ধান্ত নেন যে, সেই ছবিটি আদৌ দেখা যাবে কি না। ‘বক্স অফিস’, ‘বক্স অফিস ইন্ডিয়া’, ‘শোবিজ়ডাটা’, ‘বক্স অফিস মোজ়ো’র ওয়েবসাইট থেকে সাধারণত লাভ-লোকসানের অঙ্ক প্রকাশ করা হয়।
তবে ছবি তৈরি হওয়ার পর থেকে বক্স অফিস পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটি সহজ নয়। বড় পর্দার সামনে নায়ক-নায়িকাদের দেখতে পেলেও ক্যামেরার নেপথ্যে টেকনিশিয়ান, কর্মীদলের সদস্যের অবদান কোনও অংশে কম নয়। লেন্সের নেপথ্যে প্রধান দুই স্তম্ভ ছবির পরিচালক এবং প্রযোজকরা।
তবে, বক্স অফিসের সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে যোগসূত্র রয়েছে প্রযোজকদের। ছবি তৈরির যাবতীয় খরচ তাঁরাই বহন করেন। তারকাদের পারিশ্রমিক থেকে শুরু করে কর্মীদলের সদস্যদের বেতনও এর মধ্যে যোগ করা থাকে।
ছবি মুক্তির পরেও প্রযোজকদের দায়িত্ব শেষ হয় না। ছবির প্রচার এবং বিজ্ঞাপনের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করেন তাঁরা। ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটারদের কাছে ছবির থিয়েটার স্বত্ব বিক্রি করেন প্রযোজকরাই।
প্রেক্ষাগৃহ এবং প্রযোজকদের মাঝে রয়েছেন এই ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটারেরা। কখনও কখনও ছবি মুক্তির আগে প্রযোজকরা ডিস্ট্রিবিউটার স্বত্বও বিক্রি করে থাকে ডিস্ট্রিবিউটারদের।
এই ডিস্ট্রিবিউটাররা প্রেক্ষাগৃহের মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা চালান। যে সব প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি দেখানো হবে, সেগুলি ভাড়া নিয়ে নেন ডিস্ট্রিবিউটাররা।
ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মোট ১৪টি সার্কিটে বিভক্ত। এই ১৪টি সার্কিট হল, মুম্বই, দিল্লি/ইউপি, পূর্ব পঞ্জাব, মধ্য ভারত, সিপি বেরার, বিহার, রাজস্থান, নিজাম, তামিলনাড়ু, মাইসুরু, কেরল, ওড়িশা, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গ।
প্রতিটি সার্কিটের ডিস্ট্রিবিউটাররা সিদ্ধান্ত নেন যে, ‘সিঙ্গল স্ক্রিন’ এবং ‘মাল্টিপ্লেক্স চেন’ মিলিয়ে মোট কোন কোন প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি দেখানো হবে। দিনে কত বার স্ক্রিন পাওয়া যাবে এবং লাভ হলে কত পরিমাণ টাকা ডিস্ট্রিবিউটারদের দিতে হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
টিকিট বিক্রি শুরু হয়ে গেলে প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা টাকার হিসেবনিকেশও করতে শুরু করেন। কিন্তু মোট যত টাকার টিকিট বিক্রি হয়, তা মালিকদের হাতে থাকে না। মোট পরিমাণ থেকে রাজ্য সরকারের তরফে বিনোদন কর কেটে নেওয়া হয়।
সাধারণত, মোট পরিমাণের ৩০ শতাংশ বিনোদন কর কাটা হলেও সার্কিট অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্যে বিনোদন করের পরিমাণও ভিন্ন। এই টাকা রাজ্য সরকারের হাতে দেওয়ার পর যা বাকি থাকে, শর্ত অনুযায়ী, প্রেক্ষাগৃহের মালিক এবং ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটারদের মধ্যে তা ভাগ হয়ে যায়।
কিন্তু ‘বক্স অফিস কালেকশন’ কী ভাবে গণনা করেন ডিস্ট্রিবিউটাররা? প্রেক্ষাগৃহের মালিকের কাছে প্রতি সপ্তাহ অন্তর টাকা সংগ্রহ করেন তাঁরা। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে এই টাকার পরিমাণ সমান থাকে না।
ছবি মুক্তির পর প্রথম সপ্তাহেই সাধারণত আগ্রহী দর্শকের বেশির ভাগ ভিড় জমান প্রেক্ষাগৃহে। তাই প্রথম সপ্তাহে তুলনামূলক ভাবে বেশি পরিমাণ টিকিট বিক্রি হয়। তাই ওই সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা যা রোজগার করেন, তার ৫০ শতাংশ ডিস্ট্রিবিউটারদের হাতে দেওয়া হয়।
ছবি মুক্তি পাওয়ার দ্বিতীয় সপ্তাহে শতাংশের পরিমাণও কমে যায়। ওই সপ্তাহে টিকিট বিক্রি করে যা ব্যবসা হয়, তার ৪২ শতাংশ ডিস্ট্রিবিউটাররা সংগ্রহ করেন।
তৃতীয় সপ্তাহে এই শতাংশের পরিমাণ আরও কমে ৩০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পরবর্তী যতগুলি সপ্তাহ ছবিটি দেখানো হয়, তার উপর ৩০ শতাংশ হারেই টাকা সংগ্রহ করেন ডিস্ট্রিবিউটাররা। কিন্তু এই নিয়মগুলি শুধুমাত্র মাল্টিপ্লেক্স চেনগুলির জন্যই।
সিঙ্গল স্ক্রিনের জন্য টাকা সংগ্রহের নিয়ম আলাদা। মুক্তির পর যত সপ্তাহ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হবে, প্রতি সপ্তাহেই শতাংশের পরিমাণ একই থাকবে। ডিসট্রিবিউটাররা সাধারণত ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ টাকা প্রেক্ষাগৃহের মালিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করেন।
ছবির বাজেট, বক্স অফিস পারফরম্যান্স এবং ডিস্ট্রিবিউটারদের শেয়ারের উপর নির্ভর করে সেই ছবি ‘হিট’ বা ‘ফ্লপ’ হবে কি না, তার মাপকাঠি। যদি কম খরচে কোনও ছবি তৈরি হওয়ার পর বক্স অফিস থেকে বেশি উপার্জন করে, তা হলে সেই ছবিকে ‘হিট’ বলে মনে করা হয়। আবার বেশি খরচে বানানো ছবি যদি বক্স অফিস থেকে উপার্জন করার পরেও খরচের টাকা ওঠাতে না পারে, তা হলে সেই ছবি ‘ফ্লপ’ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
তবে, মুক্তির প্রথম সপ্তাহে ‘হিট’ হয়েছে ‘পাঠান’। এখন ‘বাহুবলী ২’ ছবিটিকে টক্কর দিয়ে ‘পাঠান’ ভারতের বক্স অফিসে ১০০০ কোটির ক্লাবে প্রবেশ করতে পারে কি না, তা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।