আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে নিহত চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহে আঘাতের একাধিক চিহ্ন ছিল। ‘যৌন হেনস্থা’র প্রমাণও মিলেছে। এমন তথ্যই উঠে এসেছে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে। সেই রিপোর্ট হাতে এসেছে আনন্দবাজার অনলাইনের।
কিন্তু ময়নাতদন্ত কী, কী ভাবে করা হয়? কী ভাবেই বা জানা গেল নির্যাতিতা চিকিৎসকের যৌন হেনস্থা হয়েছে?
ময়নাতদন্ত হল মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণের জন্য মৃতদেহের একটি বিশেষ মেডিক্যাল পরীক্ষা। ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকেন ফরেন্সিক মেডিসিনের ডিগ্রিধারী চিকিৎসক।
দেশের আইন অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যু, ফৌজদারি তদন্ত বা বিচার বিভাগীয় নির্দেশে মৃতের ময়নাতদন্ত করা হয়। কেবলমাত্র সরকারি মেডিক্যাল কলেজ তথা পুলিশ মর্গেই ময়নাতদন্ত হয়।
মৃত্যুর কত দিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত করতে হয়?
দেহ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। তবে দ্রুতই তা করে ফেলা হয়।
ময়নাতদন্ত কী ভাবে হয়?
প্রথমে মৃতদেহের বহিরঙ্গ পরীক্ষা করে দেখা হয়। নেওয়া হয় প্রয়োজনীয় নোট। এর পর দেহর কয়েকটি অংশ কেটে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সাধারণত কলা (টিস্যু)-র নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিস্তারিত পরীক্ষার জন্য শরীরের ভিতরের অঙ্গ অপসারণও করা হতে পারে। তবে পরীক্ষার পরে সেই সব অঙ্গ আবার নির্দিষ্ট জায়গায় বসানো হয়। তবে মাঝেমধ্যে আরও পরীক্ষার জন্য সেই অঙ্গগুলি রেখেও দিতে পারেন পরীক্ষক। তবে তার জন্যও নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। তদন্তকারী সংস্থা ও মৃতার পরিজনদের এ বিষয়ে জানানো বাধ্যতামূলক।
নমুনা পরীক্ষার পর তা প্রায় চার মাস সংরক্ষিত থাকে। পরে সেগুলি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নষ্ট করা হয়।
আগে দিনের আলো থাকাকালীনই ময়নাতদন্ত করা হত। ২০২১ সালে সেই নিয়মে বদল এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। বর্তমানে সূর্যাস্তের পরও ময়নাতদন্ত করা সম্ভব। তবে বিশেষ প্রয়োজন বা মামলার ক্ষেত্রে কয়েকটি হাসপাতালের মর্গে আগে থেকেই রাতে ময়নাতদন্ত করার ব্যবস্থা ছিল।
তবে খুন, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, পচনশীল মৃতদেহ-সহ অন্য কোনও আইনশৃঙ্খলা-জনিত পরিস্থিতি তৈরি না হলে রাতে ময়নাতদন্ত করা উচিত নয় বলেও নয়া প্রোটোকলে উল্লেখ রয়েছে।
কয়েকটি বিশেষ কারণে ময়নাতদন্ত করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হল— মৃত ব্যক্তির পরিচয় প্রতিষ্ঠা, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ, সময় ও পদ্ধতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া। আরজি করের নিহত চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহও ময়নাতদন্ত করে দেখা হয়েছিল। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল। তাঁর যৌনাঙ্গে জোরপূর্বক কিছু প্রবেশের উল্লেখও রয়েছে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে।
নিহত চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, তাঁর শরীরে একাধিক ক্ষতচিহ্ন ছিল। মাথা, গাল, ঠোঁট, নাক, ডান চোয়াল, চিবুক, গলা, বাঁ হাত, বাঁ কাঁধ, বাঁ হাঁটু, গোড়ালি এবং যৌনাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন মিলেছে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, চিকিৎসকের ফুসফুসে রক্ত জমাট (হেমারেজ) বেঁধেছিল। শরীরে আরও কিছু অংশেও জমাট বেঁধেছিল রক্ত। চিকিৎসক পড়ুয়াকে শ্বাসরোধ করে ‘খুন’ করা হয়েছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ।
একাধিক মহল থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, নির্যাতিতার দেহে ‘১৫০ গ্রাম সিমেন’ মিলেছে। কলকাতা হাই কোর্টে তাঁর পরিবার যে আবেদন করেছে, সেখানেও এই বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ‘সিমেন’ সংক্রান্ত কোনও উল্লেখ নেই।
রিপোর্টে লেখা হয়েছে, নির্যাতিতার ‘এন্ডোসার্ভিক্যাল ক্যানাল’ থেকে ‘সাদা ঘন চটচটে তরল’ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সেই তরল কী, তার উল্লেখ নেই রিপোর্টে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যৌনাঙ্গ (জেনিটালিয়া)-র ওজন ‘১৫১ গ্রাম’।
প্রসঙ্গত, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে নিয়ম মেনে দেহের বিভিন্ন অংশের ওজন উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই করা হয়েছে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘যে সাদা চটচটে তরলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা কী বস্তু তা ফরেন্সিক রিপোর্ট থেকে জানা যাবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এমন কিছু লেখা যায় না। কারণ, সেটা পরীক্ষাসাপেক্ষ বিষয়।’’
বিভিন্ন মহল থেকে নির্যাতিতার শরীরের একাধিক হাড় ভাঙার যে সব কথা উঠে আসছিল, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তেমন কোনও উল্লেখ নেই। গত ৯ অগস্ট সকালে আরজি কর হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চারতলার সেমিনার হলে চিকিৎসকের দেহ মিলেছিল। অভিযোগ, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে তাঁকে। এই ঘটনায় এক জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হাই কোর্টের নির্দেশে ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই। চলছে তদন্ত।