কাতারে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন ভারতের আট প্রাক্তন নৌসেনা কর্তা। তাঁদের বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলের হয়ে চরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। ২০২২ সালের অগস্ট মাস থেকে কাতারের জেলে বন্দি তাঁরা।
কাতারে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত প্রাক্তন নৌসেনা কর্তারা হলেন, ক্যাপ্টেন নবতেজ সিংহ গিল, ক্যাপ্টেন বীরেন্দ্র কুমার বর্মা, ক্যাপ্টেন সৌরভ বশিষ্ঠ, কমান্ডার অমিত নাগপাল, কমান্ডার পূর্ণেন্দু তিওয়ারি, কমান্ডার সুগুণাকর পাকালা, কমান্ডার সঞ্জীব গুপ্তা এবং নাবিক রাজেশ।
কাতারের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে নিযুক্ত বেসরকারি সংস্থা দাহ্রা গ্লোবালে কর্মরত ছিলেন নৌসেনার অবসরপ্রাপ্ত এই আট আধিকারিক। তাঁরা ছাড়া কাতারের এক জন এবং ওমানের এক নাগরিকের বিরুদ্ধেও মামলা রুজু হয়েছিল।
দাহ্রা গ্লোবালের সিইও খামিস আল-আজমি চরবৃত্তির সংক্রান্ত ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁকে দু’মাস বন্দি রেখে জামিন দেওয়া হয়। ওমানের নাগরিক মুক্তি পান ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ঠিক আগে।
দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও আট ভারতীয়কে মুক্তি দেয়নি কাতার। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও জটিল হয়েছে আইনি পদ্ধতি। বার বার তাঁদের জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে।
২০২২ সালের ১ অক্টোবর কাতারে বন্দি ভারতীয় কর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন সে দেশের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। তার পর থেকে ভারতীয় দূতাবাস নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিল। ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ শেষ বার ভারতীয়দের জামিনের আবেদন খারিজ করেছে কাতারের আদালত।
এর পর কাতারে দাহ্রা গ্লোবালের দফতর বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে যাঁরা কর্মরত ছিলেন (মূলত ভারতীয়), তাঁরা দেশে ফিরে আসেন। ২৬ অক্টোবর বন্দি ভারতীয়দের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে আদালত।
প্রাক্তন নৌসেনা কর্তাদের মৃত্যুদণ্ডের খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই বিবৃতি দেয় ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করে নয়াদিল্লি জানিয়েছে, সম্ভাব্য সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে তারা।
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ভারতে ওই আট প্রাক্তন কর্তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আশ্বাস দেন, আট জনকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে ‘সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে’ ভারত। সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি দেখছে।
বিদেশে ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া এই প্রথম নয়। এর আগে যত বারই দেশের গণ্ডির বাইরে ভারতীয় কেউ সাজা পেয়েছেন, তাঁদের উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়েছে ভারত সরকার। ঠেকানো হয়েছে মৃত্যু।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে কাতারে বন্দিদের মুক্তির জন্য ভারত সরকার কেন কোনও পদক্ষেপ করেনি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে সাজাপ্রাপ্ত আট জনের জন্য এখন কী করতে পারে নয়াদিল্লি? কোন কোন পদক্ষেপ তাদের জন্য খোলা আছে? বিশেষজ্ঞেরা তিনটি রাস্তার কথা বলছেন।
প্রথমত, ভারতীয়েরা সাজা পেয়েছেন কাতারের এক নিম্ন আদালত থেকে। সেখানে মোট চার বার শুনানি হয়েছে। উচ্চতর আদালতে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আবেদন জানাতে পারে ভারত সরকার। হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানোর সুযোগ রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে, পুরনো একটি মামলা নয়াদিল্লির হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। ২০১২ সালে কেরলে দুই ভারতীয়কে খুনের অভিযোগ উঠেছিল ইটালির দুই নাগরিকের বিরুদ্ধে। সে ক্ষেত্রে ভারত সরকার আন্তর্জাতিক আইন, মেরিটাইম জ়োন আইন ১৯৭৬ এবং ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসরণ করেছিল।
এই পুরনো মামলাটির দৃষ্টান্ত কাতারের সামনে তুলে ধরতে পারে ভারত। তার মাধ্যমেই চাওয়া হতে পারে সাজা লাঘবের নির্দেশ।
দ্বিতীয়ত, নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পেলে ১৫ দিনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন জানাতে হয়। রমজান এবং ইদের সময় কাতারের রাজা দেশের সাজাপ্রাপ্ত কিছু বন্দিকে ক্ষমাপ্রদর্শন করেন। সেখানে ইতিমধ্যেই আবেদন জানিয়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ভারতীয়দের পরিবার। ভারত সরকার এই দিকটিও নজরে রেখেছে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হয়েছে পরিবারগুলিকে।
তৃতীয়ত, ভারত এবং কাতারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সাজাপ্রাপ্তদের উদ্ধার করতে পারে নয়াদিল্লি। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে।
কাতারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ পুরনো। কাতারের পূর্বতন রাজা ১৯৯৯, ২০০৫ এবং ২০১২ সালে তিন বার ভারতে এসেছিলেন। বর্তমান রাজা ভারতে আসেন ২০১৫ সালে। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ২০০৮ সালে প্রথম বার কাতারে যান। পরে নরেন্দ্র মোদী ২০১৬ সালে এক বার কাতার সফরে গিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কাতারের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এই দেশটিকে গত কয়েক বছর ধরে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দেখা হচ্ছে। আমেরিকার সঙ্গে তার সুসম্পর্কও গড়ে উঠেছে সেই কারণেই।
তালিবানের সঙ্গে কথা বলে তাদের হাতে বন্দি আমেরিকান নাগরিকের মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এই কাতার। প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক মধুর। জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে মধ্যস্থতায় তাই বার বার কাতারের ডাক পড়ে।
অনেকে বলছেন, কাতার থেকে বন্দিদের ছাড়ানোর জন্য আমেরিকার পাশাপাশি তুরস্কের সাহায্যও নিতে পারে ভারত। কারণ, তুরস্কের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক ভাল। তবে তুরস্কের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা নড়বড়ে। তাই এই পন্থা কতটা কাজে লাগানো যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তুরস্কের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নড়বড়ে হলেও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চলে বহাল তবিয়তে। একাধিক ক্ষেত্রে ভারত এবং তুরস্ক পরস্পরের প্রতি সহৃদয়তা প্রকাশও করেছে। কিছু দিন আগে ভারত তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্কের বার্তা দিয়ে দিল্লির কুতুব মিনারে তুরস্কের জাতীয় পতাকা এঁকেছিল। তাই তুরস্কের মাধ্যমে ভারত কাতারে বন্দিদের মুক্তির জন্য আবেদন জানাতে পারে।
কাতারের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক বন্ধনও কম দৃঢ় নয়। ভারত প্রচুর পরিমাণে (৪০ শতাংশ) তরল প্রাকৃতিক গ্যাস কাতার থেকে আমদানি করে। কাতারের অনেক সংস্থার বিনিয়োগও রয়েছে ভারতে। বন্দিমুক্তির বিষয়ে এই দিকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
এই সমস্ত পন্থা কাজে না লাগলে শেষ হাতিয়ার হিসাবে রয়েছে ফোন। নয়াদিল্লি থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কাতারের রাজাকে ব্যক্তিগত ভাবে ফোন করে আট জনের সাজা মকুবের অনুরোধ করতে পারেন। দুই দেশের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে মোদীর অনুরোধ মেনে নিতে পারেন কাতারের রাজা।