১১১ বছর আগে অতলান্তিক মহাসাগরে ডুবে যাওয়া জাহাজ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ডুবোযান টাইটান। তার পাঁচ সওয়ারিরও মৃত্যু হয়েছে অতলান্তিকের অতলে।
ওশানগেট সংস্থার তৈরি টাইটানের এই চূড়ান্ত পরিণতির কারণ হিসাবে ‘ক্যাটাস্ট্রফিক ইমপ্লোশন’কে দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সমুদ্রের নীচে জলের প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে পারেনি ২২ ফুটের টাইটান।
জলের চাপে আচমকাই ভিতরের দিকে তুবড়ে গিয়েছিল ডুবোযানটি। ভিতরে থাকা পাঁচ সওয়ারি কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে টাইটানের মধ্যেই পিষে যান। তৎক্ষণাৎ তাঁদের মৃত্যু হয়।
অতলান্তিকের জল থেকে এখনও টাইটানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা যায়নি। আমেরিকা ও কানাডার উপকূলরক্ষী বাহিনী জানিয়েছে, ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রতিকূল। তাই উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
টাইটানের পরিণতি সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। তবে এই প্রথম নয়। এর আগেও অনেকে অনেক বার অতলান্তিকের সাড়ে ১২ হাজার ফুট নীচে গিয়ে দেখে এসেছেন টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ।
১৯৯৮ সালে অস্কার প্রাপ্ত হলিউড ছবি ‘টাইটানিক’-এর নির্মাতা জেমস ক্যামেরন ছবি তৈরির আগে নিজে মোট ৩৩ বার অতলান্তিকের গভীরে জাহাজের ধ্বংসাবশেষটি দেখতে গিয়েছিলেন।
ক্যামেরন-সহ অন্য অনেক পর্যটক টাইটানিকের পাড়া থেকে ঘুরে এসে নিজেদের ভয়াবহ ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। অতলান্তিকের ওই এলাকা পরতে পরতে রহস্যের জাল বিছিয়ে রেখেছে।
২০০৯ সালে ক্যামেরনের আত্মজীবনী ‘দ্য ফিউচারিস্ট’ প্রকাশিত হয়। সেখানে টাইটানিক দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন কানাডিয়ান পরিচালক। ছবির স্বার্থে যে ৩৩ বার তিনি সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন, তার মধ্যে তৃতীয় বার যেন মৃত্যুকে ছুঁয়ে ফিরে এসেছিলেন।
১৯৯৫ সালে তৃতীয় বার টাইটানিক দর্শনে গিয়ে সমুদ্রের নীচে মহাবিপদে পড়েছিলেন ক্যামেরন। ডুবোজাহাজে তিনি ছাড়াও ছিলেন পাইলট অ্যানাটোলি স্যাগালেভিচ এবং এক রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ার।
ক্যামেরুন জানান, টাইটানিকের কাছাকাছি পৌঁছে এক ভয়ঙ্কর বালিঝড়ের মুখে পড়েছিলেন তাঁরা। সমুদ্রের নীচের বালি উথালপাথাল করে ধেয়ে এসেছিল ছোট্ট ডুবোযানটির দিকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁরা সকলে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন।
ক্যামেরনদের ডুবোযানের বিদ্যুৎ পরিষেবা ব্যাহত হয়েছিল। ব্যাটারিও প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। কিছুটা ওঠার পর আবার নীচে তলিয়ে গিয়েছিল যানটি। তিন বার চেষ্টা করার পর ডুবোযানটিকে আবার সচল করতে পেরেছিলেন তাঁরা।
তবে সমুদ্রের বালিঝড় বড় কোনও ক্ষতি করতে পারেনি ক্যামেরনদের। পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় সমুদ্রপৃষ্ঠ ভেদ করে দিনের আলোয় মাথা তুলতে পেরেছিলেন তাঁরা।
১৯৯১ সালে কানাডার সমুদ্রতলের চিকিৎসক জো ম্যাক্কিনিস টাইটানিকের পাড়ায় ঢুঁ মেরে আসার ১৭টি অভিযানে শামিল হয়েছিলেন। শেষ বারের অভিযানে বিপদে পড়েন তিনি।
ম্যাক্কিনিসদের ডুবোযানটি টাইটানিক দর্শনের পর উপরে ওঠার সময় আটকে গিয়েছিল। কিছুতেই সমুদ্রতল থেকে উপরের দিকে তোলা যাচ্ছিল না যানটিকে। খবর পেয়ে দ্বিতীয় একটি সাহায্যকারী যান পাঠানো হয়।
সাহায্যকারী যানটি গিয়ে দেখে, ম্যাক্কিনিসদের যানের একটি অংশ আটকে আছে সমুদ্রের তলার তারের জটে। দীর্ঘ ক্ষণের চেষ্টার পর কৌশলে সেই জট থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন তাঁরা।
২০০০ সালে আর এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী মাইকেল গুইলেন টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলেন। টাইটানিক অভিযানে যাওয়া প্রথম সাংবাদিক তিনিই। অতলান্তিকের বিপদ তাঁরও পিছু নিয়েছিল।
গুইলেন জানান, তাঁদের ডুবোযান যে মুহূর্তে জাহাজের সামনের ভাঙা অংশটি অতিক্রম করে, তখনই তাঁরা অনুভব করেন, তাঁরা দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। সমুদ্রতলের আকস্মিক চোরাস্রোতের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন গুইলেনরা।
গুইলেন জানান, স্রোতের টানে তাঁদের ডুবোযান তরতরিয়ে এগিয়ে টাইটানিকের প্রপেলারে সজোরে ধাক্কা খায়। সেখানে ঘণ্টাখানেক আটকে ছিলেন তাঁরা। পরে আবার উপরে উঠতে পেরেছিলেন।
অতলান্তিকের সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে এমনই অনেক বিপর্যয় লুকিয়ে আছে। সময়ে সময়ে যাঁরা উঁকি মারে অভিযাত্রীদের ডুবোযানের জানলা দিয়ে। কেউ বিপদ এড়াতে পারেন, কারও পরিণতি হয় টাইটানের মতো।
১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে উত্তর অতলান্তিক সাগরে ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক। এই জাহাজে ২,২২৪ জন যাত্রী ছিলেন। দেড় হাজারের বেশি মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যান। জাহাজের ধ্বংসাবশেষ রয়ে গিয়েছে অতলান্তিকের গভীরে।