সংসদের দুই কক্ষেই পাশ হয়েছে সংশোধিত ওয়াকফ বিল। নিয়মমাফিক এ বার তা পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। তিনি সই করলেই আইনে পরিণত হবে এই বিল। সংসদে বিলটি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের সময়ে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে থাকা বিপুল জমির প্রসঙ্গ তুলে সুর চড়ায় বিজেপি-সহ কেন্দ্রের শাসক শিবির। পাল্টা যুক্তি দিয়েছে বিরোধীরা।
মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মীয় এবং দাতব্য উদ্দেশ্যে দান করা বা নিবেদিত সম্পত্তির দেখভাল করে থাকে ওয়াকফ বোর্ড। এর মধ্যে রয়েছে মসজিদ, দরগা, সমাধিস্থল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি তথ্য বলছে, রেল এবং প্রতিরক্ষা দফতরের পর দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ জমির মালিক ওয়াকফ বোর্ড।
সংসদে সংশোধিত ওয়াকফ বিলের বিতর্কে যোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট বোর্ডটির হাতে কত পরিমাণ জমি রয়েছে, তার খতিয়ান দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর দাবি, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ওয়াকফের সম্পত্তি ছিল মাত্র দু’টি গ্রাম। বর্তমানে সেটা বাড়তে বাড়তে ৩৯ লক্ষ একরে গিয়ে পৌঁছেছে।
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের দাবি, গত ১২ বছরে ওয়াকফ বোর্ডের জমির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপারে লোকসভায় শাহ বলেন, ‘‘১৯১৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বোর্ডটির হাতে মোট ১৮ লক্ষ একর জমি ছিল। এর পর ওয়াকফ আইন সংশোধন করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার।’’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, ২০১৩ সালে ওয়াকফ আইন সংশোধন করার পর বোর্ডটির ক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত ২১ লক্ষ একর জমি সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে ওয়াকফ বোর্ড। একে আইনের ‘অপব্যবহার’ এবং ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ বলে উল্লেখ করেন মোদী মন্ত্রিসভার ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ অমিত শাহ।
উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৯৫ সালে এক বার ওয়াকফ আইন সংশোধন করেছিল কেন্দ্র। সে বার ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নতির জন্য আইনে বদল আনে সরকার। প্রশাসনের দেওয়া আগের তথ্য অনুযায়ী, একটা সময়ে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে ছিল ৯.৪ লক্ষ একর জমি। মোট ৮.৭২ লক্ষ সম্পত্তির দেখভাল করত তারা।
নিয়ম অনুযায়ী, ওয়াকফের সম্পত্তি বিক্রি করা বেআইনি। কিন্তু, বার বার এই বোর্ডের বিরুদ্ধে জোর করে জমি দখল করা এবং ২০১৩ সালের আইনের ‘অপব্যবহার’-এর অভিযোগ উঠেছে। ফলে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ এবং জরিপ সংক্রান্ত ব্যাপারে দেখা গিয়েছে জটিলতা, সংসদে জানিয়েছে সরকারপক্ষ।
সংসদে শাহ বলেছেন, ওয়াকফ সম্পত্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘২০ হাজার সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ডের লিজ়ে ছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের রেকর্ড অনুযায়ী, যেটা ভুলও হতে পারে। ওই সম্পত্তির কোনও অস্তিত্ব নেই। সেগুলি তা হলে কোথায় গেল? কার অনুমতিতে বিক্রি করা হয়েছে?’’
বর্তমানে দেশে মোট ৩০টি ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। তাদের হাতে থাকা জমির পরিমাণ ৯.৪ লক্ষ একর ধরা হলে, সেখানেও প্রকাশ্যে এসেছে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওই পরিমাণ জমি ৩০টি দেশের আয়তনের চেয়ে বেশি বলে জানা গিয়েছে।
পাশাপাশি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে দাবি করা বেশ কিছু জমি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেই তালিকায় আছে তামিলনাড়ুর ১,৫০০ বছরের পুরনো চোল মন্দির, ৬০০ জনের বেশি খ্রিস্টান পরিবারের কেরলের একটি গ্রাম এবং কর্নাটকের একটি বিলাসবহুল হোটেল।
তবে দেশের সর্বাধিক জমির মালিকানা আছে সেনা এবং অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর কাছে। তাদের অধিকারে থাকা জমির পরিমাণ ১৭.৩১ লক্ষ একর (৭,২৮০ বর্গ কিলোমিটার)। এ ছাড়া দ্বিতীয় স্থানে থাকা রেল মন্ত্রকের হাতে আছে ১১.৭২ লক্ষ একর (৪,৭৮০ বর্গ কিলোমিটার) জমি।
বর্তমানে আইনে, ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তিতে কোনও ভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ থাকে না। কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারে ওয়াকফ বোর্ড। তাতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না সরকারের।
সংশোধিত ওয়াকফ বিলে এই নিয়ম পুরোপুরি বদলে ফেলার কথা বলেছে কেন্দ্র। এটি পাশ হলে বিলুপ্ত হবে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার। কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা জেলাশাসক বা সম পদমর্যাদার আধিকারিকদের হাতে দিতে চলেছে মোদী সরকার।
পাশাপাশি, নতুন বিলে ওয়াকফ বোর্ডে ইসলাম-বহির্ভূত দু’জন সদস্যের অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্রীয় পোর্টালে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি এবং জমি নথিভুক্ত করতে বলা হয়েছে। বিলটির বিরোধীদের দাবি, ওয়াকফ বোর্ডের বিভিন্ন সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই ওই বিল এনেছে কেন্দ্র।
জামাত-এ-ইসলামি হিন্দ এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মতো প্রধান মুসলিম সংগঠনগুলির মতে, পদ্মশিবির দীর্ঘ সময় ধরেই দিল্লি-সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সেই কারণেই তড়িঘড়ি পাশ করা হয়েছে এই সংশোধনী বিল। যদিও কেন্দ্রের যুক্তি, খোদ মুসলিম সমাজের গরিব এবং মহিলারাই নাকি এত দিন ওয়াকফ আইন সংস্কারের দাবি জানাচ্ছিলেন।
গত বছরের ৮ অগস্ট লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। দীর্ঘ বিতর্কের শেষে ঐকমত্যের লক্ষ্যে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটির (জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি বা জেপিসি) কাছে পাঠায় সরকার। গত ৩০ ডিসেম্বর ১৪টি সংশোধনী-সহ বিলটি সংসদে পেশ করার জন্য সুপারিশ করে জেপিসি।
যৌথ সংসদীয় কমিটিতে সরকার পক্ষের তরফে ২৩ এবং বিরোধীদের তরফে ৪৪টি সংশোধনী প্রস্তাব জমা পড়েছিল। এর মধ্যে সরকার পক্ষের তরফে ২৩ এবং বিরোধীদের তরফে ৪৪টি সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিরোধীদের সব ক’টি প্রস্তাবই খারিজ করে দেয় জেপিসি।
এ বছরের ২ এপ্রিল গভীর রাতে লোকসভায় পাশ হয় সংশোধিত ওয়াকফ বিল। এর পক্ষে ২৮৮ এবং বিপক্ষে ২৩২ জন সাংসদ ভোট দেন। অর্থাৎ, ব্যবধান ছিল ৫৬। মোট ভোট পড়ে ৫২০। ভোটাভুটির আগে দীর্ঘ সময় ধরে বিলটি নিয়ে চলে আলোচনা।
ঠিক তার পরের দিন (পড়ুন ৩ এপ্রিল) রাজ্যসভায় বিলটি তোলে সরকারপক্ষ। সেখানে লম্বা সময় ধরে বিতর্ক চলার পর ভোটাভুটি চায় বিরোধীরা। বিলের পক্ষে ১২৮টি ভোট পড়ে। আর বিপক্ষে পড়ে ৯৫টি ভোট। অর্থাৎ, ৩৩ ভোটের ব্যবধানে ওয়াকফ বিল রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায়।