পরনে গোলাপি রঙের লেহঙ্গা। গলায় হিরে-পান্নার নেকলেস। কনের মাথায় ফুলের শামিয়ানা। আস্তে আস্তে খুলে গেল ফটক। আলতো পায়ে এগোলেন কনে। সামনে দাঁড়িয়ে বর। তাঁর চোখেমুখে ভালবাসার ঝিলিক। বরকে দেখে কনের মুখে লজ্জা মাখানো তৃপ্তির হাসি। ধীর লয়ে বাজছে গান। তার পর বর-কনের আলিঙ্গন। মালাবদল হতেই শুরু হল পুষ্পবৃষ্টি। বলিউডের তারকা জুটি সিদ্ধার্থ মলহোত্র এবং কিয়ারা আডবাণীর রূপকথার বিয়ের এমন ঝলকই প্রকাশ্যে এসেছে। যা দেখে মজেছেন ভক্তরা। তাঁদের এমন রাজকীয় বিয়ের ভালবাসার মুহূর্তগুলি যাঁর দৌলতে ক্যামেরাবন্দি হয়েছে, তিনি বিশাল পঞ্জাবি।
বিশালের সৃজনশীলতার জাদুতেই সিড-কিয়ারার রূপকথার বিয়ের মুহূর্তগুলি আরও আবেগঘন হয়েছে। উপচে পড়েছে আবেগ আর ভালবাসা। যার পরতে পরতে রয়েছে রোম্যান্স।
বিয়ের সুন্দর মুহূর্তগুলি সারা জীবনের জন্য একটা ‘গোল্ডেন মেমোরি’ হয়ে থাকে। তাই ইদানীং, বিয়ের ভিডিয়োগ্রাফারের চাহিদা নেহাত কম নয়। কিন্তু সব ভিডিয়োগ্রাফারের সঙ্গে বিশালকে এক বন্ধনীতে ফেলা ঠিক হবে না। কারণ, খ্যাতনামীদের বিয়ের গল্প যে ভাবে ক্যামেরায় তুলে ধরেন, সেই মুন্সিয়ানায় বাজিমাত করেছেন বিশাল।
কে এই বিশাল? বিয়ের মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করার জন্য কেনই বা এই ৪৩ বছরের যুবকের উপর ভরসা করেন খ্যাতনামীরা? সেই কাহিনিই এখানে তুলে ধরা হল।
১৯৮০ সালের ১০ জুলাই জন্ম বিশালের। তাঁর জন্ম ঘানায়। সে দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে তাঁর। তবে রয়েছে ভারতের নাগরিকত্বও। জন্মের ১০ বছর পর বিশালের পরিবার ইংল্যান্ড চলে যায়।
ছোটবেলা থেকেই বলিউডের প্রতি ঝোঁক ছিল বিশালের। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে চেয়েছিলাম বলিউডে কাজ করব।’’ সেই মতো ইংল্যান্ডে ‘ফিল্ম মেকিং’ নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। বলিউডে কাজ করার স্বপ্নও সত্যি হয় বিশালের।
২০০১ সালে পরিচালক সন্তোষ শিবনের ‘অশোকা’ ছবিতে ভিজ়্যুয়াল এফেক্টসের উপর কাজ করেন বিশাল। এর পর ২০০৪ সালে পরিচালক ফারহা খানের ‘ম্যাঁয় হুঁ না’ ছবিতেও কাজ করেন তিনি। এ ছাড়াও, ২০০৫ সালে শাহরুখ খানের ‘পহেলি’ এবং পরের বছর, ২০০৬ সালে ‘ডন’ ছবিতেও কাজ করেন বিশাল। ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘হানিমুন ট্র্যাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’ ছবিতেও বিশালের ভূমিকা ছিল।
শাহরুখের একের পর এক ছবিতে কাজ করার সূত্রে সুপারস্টারের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সেই সূত্রেই শাহরুখের সংস্থা ‘রেড চিলিজ় এন্টারটেনমেন্ট’-এ যোগ দেন বিশাল। শাহরুখের সংস্থায় বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ শুরু করেন। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল— এই ৯ বছর শাহরুখের সংস্থায় কাজ করেন বিশাল।
এর পর বিয়ের ভিডিয়োগ্রাফির কাজে মন দেন বিশাল। সাল ২০১০। সে বছর সাত পাকে ঘোরেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘নিজের বিয়েতে ভিডিয়োগ্রাফি করার সামর্থ্য ছিল না। আমার কয়েক জন বন্ধু ছিল, যাঁরা সিনেম্যাটোগ্রাফার। তাঁরাই শ্যুট করেন।’’
বিশালের নিজের বিয়ের সেই ভিডিয়ো ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এর পরই বিয়ের ভিডিয়ো নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। তৈরি করে ফেলেন পঞ্জাবি তথ্যচিত্র ‘হার্টবিটস’। যা ভারতের প্রথম বিয়ের ছবি হিসাবে পা রেখেছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।
এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বিয়ের মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করার কাজে নিজের মন-প্রাণ ঢেলে দেন বিশাল। যাত্রা শুরু হয় ‘দ্য ওয়েডিং ফিল্মার’-এর। যা বিশালেরই সংস্থা।
২০১০ সালে যখন তাঁর এই সংস্থার পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই সময় সেখানে কাজ করতেন মাত্র ৪ জন। এখন সেই সংখ্যাটা ৬০। মূলত খ্যাতনামীদের বিয়ের সুন্দর মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করে তা ভিডিয়ো তৈরি করে থাকে এই সংস্থা। ঠিক যেমনটা সিদ্ধার্থ-কিয়ারার বিয়ের জন্য করেছে বিশালের সংস্থা।
তবে শুধু সিড-কিয়ারাই নন। বিরাট-অনুষ্কা, রণবীর-দীপিকা, বিপাশা-করণের বিয়ের ভিডিয়ো তৈরির নেপথ্য কারিগরও ছিলেন বিশাল।
মজার কথা হল, খ্যাতনামীদের বিয়ে নিয়ে অনেক গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। বিয়ের ছবি বা ভিডিয়ো যাতে কোনও ভাবেই আগে ফাঁস না হয়, সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকেন তারকারা। এই গোপনীয়তার কথা বলতে গিয়ে এক মজার কাহিনি ভাগ করেছেন বিশাল।
এক সাক্ষাৎকারে বিশাল বলেছেন, ‘‘বিরাট-অনুষ্কার বিয়ের ভিডিয়োর জন্য যে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা আগে জানতামই না। বিয়ের এক দিন আগে জানতে পারি। বিয়ের পর ভিডিয়ো সম্পাদনার সময়ও আমাদের চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়েছিল।’’
তারকাদের বিয়ে বলে কথা! ফলে সেই বিয়ের বহর যে রাজকীয় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন রাজকীয় বিয়ের ভিডিয়ো করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশালের কথায়, ‘‘খ্যাতনামীদের বিয়েতে যে হেতু অতিথিদের সংখ্যা খুবই কম হয়। তাই আমাদের কর্মীর সংখ্যাও কম রাখা হয়। বিরাট-অনুষ্কার বিয়েতে যেমন আমাদের সংস্থার ২-৩ জন ছিলেন।’’
বিয়ের ভিডিয়োয় কী আবহসঙ্গীত ব্যবহার করা হবে, সে নিয়েও মাথা খাটাতে হয় বিশালকে। বিরাট-অনুষ্কার বিয়েতে যেমন ব্যবহার করা হয়েছিল সুফি গান। আবার সিড-কিয়ারার বিয়েতে ব্যবহার করা হয়েছে তাঁদেরই ছবি ‘শেরশাহ’-এর গান। তবে অনেক সময়ই নিজেই গান লিখে সুর দেন বিশাল।
শুধু যে ‘রিয়েল লাইফ’-এর বিয়ের ভিডিয়োই তৈরি করেন বিশাল তা নয়, পর্দার বিয়েতেও নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন বিশাল। ২০১৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায়ের ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’। এই ছবিতে ‘কবিরা’ গানে অভিনেত্রী কল্কি কেঁকলার চরিত্রের বিয়ের দৃশ্যায়ন যাঁর হাতে ফুটে উঠেছে, তিনি বিশাল।
বিয়ের ভিডিয়োতে তাঁর হাত পাকানোর নেপথ্যে রয়েছে শাহরুখের অবদান। ভিডিয়ো কী ভাবে সম্পাদনা করতে হয়, তা তাঁকে শিখিয়েছেন স্বয়ং শাহরুখ। এ কথা নিজেই জানিয়েছেন বিশাল। তাঁর কথায়, শাহরুখ খুবই ভাল এক জন সম্পাদক। ছবি কী ভাবে সম্পাদনা করতে হয়, তা তিনিই শিখিয়েছেন।
বিশালের কথায়, ‘‘বলিউডে কাজ করার সময় আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। যা পরে বিয়ের ভিডিয়ো তৈরিতে খুব সাহায্য করেছে।’’ পরিচালক ফারহা খানের কাছেও শিখেছেন ভিডিয়ো সম্পাদনার কাজ। বিশাল বলেছেন, ‘‘যে কোনও বিয়েতেই ভিডিয়োর মাধ্যমে একটা ছোট গল্প বলার চেষ্টা করি।’’