মাথায় জটা। তার নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে সোনার টিকলি। কপালে লম্বা লাল টিপ। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে গেরুয়া শাড়ি। তরুণী যখন জেনেভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরে ইংরেজিতে বক্তৃতা করছিলেন, তখন উপস্থিত সকলেই বেশ নড়েচড়ে বসেছিলেন। ইনি কে? এ রকম সাজপোশাক কেন? কোন দেশেরই বা প্রতিনিধি? পরে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টের পর তরুণীর পরিচয় প্রকাশ্যে আসে। বেশ হইচই পড়ে যায়।
স্বঘোষিত গুরু নিত্যানন্দের টুইটার অ্যাকাউন্টে ওই তরুণীর ছবি পোস্ট করে পরিচয় দেওয়া হয়। নিত্যানন্দের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। ভারতীয় পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেননি। তিনি ফেরার। সেই নিত্যানন্দই ফলাও করে দিয়েছেন তরুণীর ছবি। জানিয়েছেন, কে তিনি।
নিত্যানন্দ দাবি করেছেন, নিজের এক দেশ তৈরি করেছেন তিনি। নাম ‘ইউনাইটেড স্টেট অব কৈলাস’। সে দেশে সকলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী। শুধু হিন্দুদের জন্যই তৈরি হয়েছে এই দেশ। সেখানে হিন্দুদের সংস্কার, ঐতিহ্যকে লালন করা হয়। এ বার সেই ‘ভার্চুয়াল সার্বভৌম দেশ’ থেকেই রাষ্ট্রপুঞ্জের দরবারে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন নিত্যানন্দ। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন এক মহিলা। সেই নিয়ে সমাজমাধ্যমে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন নিত্যানন্দ।
নিত্যানন্দ যা-ই দাবি করুন, তাঁর তৈরি এই দেশের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। আদৌ কৈলাসকে দেশের স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। ইকুয়েডরের থেকে জমি কিনে সেই দেশ তৈরি করেছেন নিত্যানন্দ। চলতি সপ্তাহে নিজের তৈরি দেশের তরফে বিবৃতিও দিয়েছেন নিত্যানন্দ। তাতে দাবি করেছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন ‘মা বিজয়প্রিয়া নিত্যানন্দ’। বিবৃতিতে আরও দাবি করা হয়েছে, বিজয়প্রিয়াই রাষ্ট্রপুঞ্জে কৈলাস দেশের স্থায়ী রাষ্ট্রদূত।
২৪ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় হয়েছিল ১৯তম অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে সম্মেলন। সেখানেই যোগ দিয়েছেন ইউনাইটেড স্টেট অব কৈলাস দেশের প্রতিনিধিরা।
কে এই বিজয়প্রিয়া নিত্যানন্দ? কৈলাসের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে জানা গিয়েছে, বিজয়প্রিয়া রাষ্ট্রপুঞ্জে কৈলাস দেশের স্থায়ী রাষ্ট্রদূত। তিনি নিজেকে ওয়াশিংটনের বাসিন্দা বলে দাবি করেছেন। ওই সম্মেলনে গিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা করেছেন বিজয়প্রিয়া। সেই ছবি রয়েছে।
একটি ছবিতে দেখা গিয়েছে, আমেরিকার রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে সই করছেন বিজয়প্রিয়া। কী সেই চুক্তি, জানা যায়নি। বিজয়প্রিয়া এও দাবি করেছেন, বিভিন্ন দেশে নিজেদের দূতাবাস এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন খুলেছে ইউনাইটেড স্টেট অব কৈলাস।
সূত্রের খবর, কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতক পাশ করেছিলেন বিজয়প্রিয়া। পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বৃত্তিও পেয়েছেন।
বিজয়প্রিয়ার লিঙ্কডিন প্রোফাইল থেকে জানা গিয়েছে, চারটি ভাষা বলতে পারেন তিনি। ইংরেজি, ফরাসি, ক্রেওল, পিডজিনস।
সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, নিত্যানন্দ তাঁর গুরু। গুরুকে প্রণামের বদলে মাথায় হাত ঠেকিয়ে কুর্নিশ জানিয়েছেন। এও দাবি করেছেন, কখনও গুরু নিত্যানন্দ বা কৈলাসকে ছেড়ে যাবেন না।
বিজয়প্রিয়া ছাড়াও কৈলাস দেশের আরও পাঁচ মহিলা প্রতিনিধি রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা সেখানে গুরুর হয়ে সওয়াল করেছেন। বিজয়প্রিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তাঁর গুরুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা চালাচ্ছে ভারত। তাঁর দাবি, ‘হিন্দু সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার’-এর চেষ্টা করেছেন বলেই তাঁর গুরু হেনস্থার শিকার।
ভারতে নিত্যানন্দের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা চলছে। নিত্যানন্দ যদিও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে বিজয়প্রিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর গুরু নিত্যানন্দের বিরুদ্ধে বিচার ঠেকানোর জন্য কী পদক্ষেপ করা যেতে পারে? কৈলাসের ২ কোটি হিন্দুর বাস। তাঁদের স্বীকৃতির জন্যই বা কী পদক্ষেপ করা যেতে পারে? বিজয়প্রিয়া বার বার দাবি করেছেন, তাঁর গুরু ‘নির্দোষ’।
বিজয়প্রিয়া যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে দাবি করেছেন, তাঁর গুরু নিজের জন্মভূমি ভারতকে শ্রদ্ধা করেন। কৈলাসের নাগরিকেরাও ভারতকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু সে দেশের কিছু ‘হিন্দুত্ব-বিরোধী’ গুরুকে ‘নির্যাতন’ করেছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনের ছবি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি কৈলাসকে স্বীকৃতি দিল তারা! রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়ে দিয়েছে, ‘স্বঘোষিত গুরু’-র সংগঠনের পেশ করা কোনও তথ্যই তারা গ্রহণ করেনি। স্বীকৃতি দেয়নি।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাই কমিশনারের দফতর জানিয়েছে, জেনেভা সম্মেলনের দরজা যখন সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল, তখনই নিজের বক্তব্য রেখেছিলেন বিজয়প্রিয়া। একটি ‘স্বেচ্ছাসেবী’ সংগঠন হিসাবেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল কৈলাসের প্রতিনিধিরা। ইউনাইটেড স্টেট অব কৈলাসকে তারা কখনওই দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি।