কোনও ছবি মুক্তির আগে তা সেন্সর বোর্ডের হাত দিয়েই পাশ হয়। ছবির কোনও সংলাপ অথবা কোনও দৃশ্য আপত্তিকর মনে হলে তাতে কাঁচি চালানোর নির্দেশ দেন সেন্সর বোর্ডের সদস্যেরা। কিন্তু এক অভিনেত্রীর আবেদনময়ী চোখের কারণেও কি ছবিতে কাঁচি চালানো যেতে পারে? অদ্ভুত মনে হলেও এক বার এমনটাই করেছিল সেন্সর বোর্ড।
১৯৬০ সালে গুরু দত্তের প্রযোজনায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘চৌধবীঁ কা চাঁদ’। এই ছবি প্রযোজনার পাশাপাশি মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গুরু দত্ত নিজেই। তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান। গুরু দত্ত এবং ওয়াহিদা ছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায় অভিনেতা রহমানকে। এই ছবিতেই অভিনেত্রীর চোখের কারণে কাঁচি চালিয়েছিল সেন্সর বোর্ড।
পুরনো এক সাক্ষাৎকারে ওয়াহিদা স্মৃতির খাতা থেকে কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘চৌধবীঁ কা চাঁদ’ ছবির মূল গানে তাঁর চোখ নাকি অন্য রকম দেখতে লাগছিল। তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল সেন্সর বোর্ড।
ওয়াহিদার কথায়, ‘‘গুরু দত্ত যখন ‘চৌধবীঁ কা চাঁদ’ ছবিটি শুট করেছিলেন, তখন তা সাদা-কালোয় শুট করা হয়েছিল। কিন্তু ছবিটি এত দেরি করে মুক্তি পায় যে, সেই সময় বাজারে রঙিন ছবি চলছে। সে কারণে অভিনব সিদ্ধান্ত নেন গুরু দত্ত।’’
সাদা-কালোয় ছবি শুট করার পর আবার নতুন করে ‘চৌধবীঁ কা চাঁদ’ ছবিটি সম্পূর্ণ রঙিন ভাবে শুট করা সম্ভব ছিল না। তাই গুরু দত্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই ছবির মূল গানটি শুধুমাত্র রঙিন ফ্রেমে শুট করবেন তিনি।
নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘চৌধবীঁ কা চাঁদ’ ছবিটির মূল গান শুট করেন গুরু দত্ত। ছবিটি সম্পাদনার কাজ শেষ করার পর সেন্সর বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়। ওয়াহিদা জানিয়েছিলেন, পুরো ছবিটি দেখে কোনও রকম সংশয় প্রকাশ না করলেও ছবির মূল গানটি নিয়েই বেঁকে বসে সেন্সর বোর্ড।
দর্শকের নজর কাড়তেই ছবির মূল গান রঙিন ফ্রেমে শুট করেছিলেন গুরু দত্ত। তা নিয়েই সেন্সর বোর্ড আপত্তি জানানোয় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
ওয়াহিদা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, সেন্সর বোর্ডের সদস্যেরা গুরু দত্তকে জানান যে, ‘চৌধবীঁ কা চাঁদ’ ছবির মূল গান থেকে দু’টি দৃশ্যে কাঁচি চালাতে হবে। তা হলেই ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে নির্দ্বিধায় মুক্তি পেতে পারে।
গানের দৃশ্যে কেন কাঁচি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের প্রশ্ন করলে তাঁরা গুরু দত্তকে জানিয়েছিলেন, ওই দু’টি দৃশ্যেই নাকি ওয়াহিদার চোখ লাল হয়ে রয়েছে। ফলে তাঁকে অনেক বেশি আবেদনময়ী লাগছে। তা শুনে হাসিতে ফেটে পড়েন গুরু দত্ত।
সেন্সর বোর্ডকে গুরু দত্ত জানা, রঙিন ফ্রেমে গানটি শুট করার কারণে সেটে অনেক চড়া আলোর ব্যবহার হয়েছে। আলোর তীব্রতায় শুটিং করতে অসুবিধা হচ্ছিল ওয়াহিদার। তাই শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে চোখের উপর বরফ ঘষছিলেন অভিনেত্রী।
বার বার চোখে বরফ ঘষার ফলে অভিনেত্রী আরাম পেলেও তাঁর চোখ দু’টি লাল হয়ে যায়। আর সেটাই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেন্সর বোর্ডের কাছে।
সেন্সর বোর্ডের সদস্যেরা গুরু দত্তকে বলেছিলেন, ‘‘এই গানে ওয়াহিদার চোখ প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত আবেদনময়ী লাগছে। দর্শক এই বিষয়টি ভাল ভাবে গ্রহণ না-ও করতে পারে।’’
গুরু দত্ত কিছুতেই হার মানতে রাজি ছিলেন না। তিনি সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের বলেছিলেন, ‘‘এই গানটি এক স্বামী-স্ত্রীর গল্পকে ঘিরে বানানো হয়েছে। তাতে যদি অভিনেত্রীর চোখ সামান্য আবেদনময়ী লাগে তাতে ক্ষতি কী?’’
গুরু দত্তের কথা শুনে আর বিশেষ আপত্তি জানায়নি সেন্সর বোর্ড। দু’টি দৃশ্যের পরিবর্তে শুধুমাত্র একটি দৃশ্যেই কাঁচি চালাতে হয় গানটিতে। তার পর ছবিটি মুক্তি পায় এবং দর্শকের কাছে বিপুল প্রশংসা কুড়োয়।
ওয়াহিদা সাক্ষাৎকারে মশকরা করে বলেছিলেন, ‘‘সেন্সর বোর্ডে সেই সময় যে সদস্যেরা ছিলেন, ভাগ্যিস তাঁরা এখন নেই। না হলে এখনকার ছবি দেখে যে তাঁরা কী করতেন!’’