গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অ্যাপ ক্যাবে চড়েছিলেন রামভদ্রন সুন্দরম। গাড়িতে উঠে চালকের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেন তিনি। আলাপচারিতা কিছুটা এগোনোর পর চালকের পরিচয় শুনে চমকে ওঠেন রামভদ্রন। যিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁকে দেখে ক্যাবচালক মনে হলেও আদতে তিনি একজন বিজ্ঞানী।
উথায়া কুমার। তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীর একটি ছোট শহরে জন্ম। লেখাপড়ায় যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন। স্বপ্ন ছিল মহাকাশ গবেষণায় যোগ দেওয়ার। পিএইচডি শেষ করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় (ইসরো) তাঁর স্বপ্নের চাকরিতে যোগও দেন তিনি। সেখানে মহাকাশ জ্বালানি সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বভার ছিল তাঁর হাতে।
সাত বছর ধরে ইসরোর কর্মী হিসাবে দায়িত্ব সামলাবার পর স্বপ্নের চাকরিকে বিদায় জানান উথায়া। পরিসংখ্যান তত্ত্বে এম ফিল করা ইসরোর এই বিজ্ঞানী শুরু করেন নিজের ব্যবসা। ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে তাঁর ক্যাব সংস্থা। সাত বছর আগে গুটি কয়েক গাড়ি নিয়ে অনলাইনে যাত্রী পরিষেবার যে সংস্থা পথ চলা শুরু করেছিল এখন তার বার্ষিক আয় ২ কোটি টাকা।
উথায়ার বাবা ও মায়ের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি ক্যাব সংস্থার অধীনে এখন রয়েছে ৩৭টি গাড়ি। তবে শুরু দিকের পথচলা খুব একটা মসৃণ ছিল না উথায়ার। নিশ্চিত আয়ের চাকরি ছেড়ে স্টার্ট আপ সংস্থা খোলার ঝুঁকির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন উথায়া।
বেশ কয়েক দিন আগে লিঙ্কডইন সমাজমাধ্যমে একটি সংস্থার আধিকারিক সুন্দরম তাঁর সঙ্গে উথায়ার আলাপচারিতা তুলে ধরেন। সেই আলাপের সূত্র ধরেই উথায়ার জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে, ইসরো ছাড়ার পর একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন উথায়া। সেই চাকরিও ছেড়ে দেন। তার পরে নিজেই একটি সংস্থা খোলার তোড়জোড় শুরু করেন। সেই ইচ্ছার প্রধান বাধা ছিল বিনিয়োগ। উথায়ার দিকে সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দেন তাঁরই কয়েক জন বন্ধু।
সেই টাকা দিয়ে তাঁর বাবা সুকুমারন এবং মা তুলসীর নাম দিয়ে ক্যাব সংস্থা চালু করেন। উথায়া এই সফরে সব সময় পাশে পেয়েছেন নিজের ভাইকে। প্রথম দিকে ব্যবসায় নানা বাধার সম্মুখীন হলেও ধীরে ধীরে পায়ের তলার জমি শক্ত করেছেন উথায়া। ৩৭টি গাড়ির ঋণ শোধ হতে আর মাত্র তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন তিনি।
ব্যবসার গোড়ার দিকে কুমারের প্রধান লক্ষ্য ছিল তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি। সংস্থার কর্মীদের যাতায়াত করার জন্য দ্রুত পরিষেবা দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করেন তিনি। দৈনিক তিন বার কর্মীদের নিয়ে আসতেন ও পৌঁছে দিতেন। প্রতি ট্রিপ থেকে তাঁর ২ হাজার ৭০০ টাকা আয় হত।
শীঘ্রই তাঁর এই পরিকল্পনা সাফল্যের মুখ দেখে। কিন্তু এখানেই থেমে থাকতে রাজি নন ইসরোর প্রাক্তন বিজ্ঞানী। তিনি এখন বহুল প্রচারিত অনলাইন ক্যাব সংস্থাগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের সংস্থার পরিষেবায় বৈচিত্র আনছেন।
উথায়া মনে করেন তাঁর ক্যাব সংস্থা সাধারণ ট্যাক্সি পরিষেবা নয়। তিনি তাঁর সংস্থার চালকদের শুধুমাত্র চালক মনে করেন না। বরং সংস্থার অংশীদার বলে মনে করেন।
সে কারণে অন্য ক্যাব সংস্থাগুলির থেকে একে আলাদা ধরা হয়। চালকদের প্রতি কুমারের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য সংস্থার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্দিষ্ট বেতন প্রদানের পরিবর্তে তিনি সংস্থার লাভের ৭০ শতাংশ তুলে দেন চালকদের হাতে।
তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সংস্থাটি আড়ে-বহরে বাড়ছে। বেতনের পরিবর্তে লভ্যাংশ দেওয়ার বিষয়টি চালকদের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে যে চালকেরাও এই সংস্থায় বিনিয়োগ করা শুরু করে দিয়েছেন।
চালকদের বেতনভুক করার পরিবর্তে মালিকানার অনুভূতি দেওয়া ব্যবসায় সাফল্যের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন উথায়া।
ব্যবসায়িক সাফল্য সত্ত্বেও, কুমার নিজের সাদামাঠা জীবনযাত্রা থেকে সরে আসেননি। তিনি ব্যক্তিগত ব্যয়ের জন্য মাসে দেড় লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছেন। সংস্থার আয় থেকে যে লাভ হয় তা দিয়ে দু’টি খাতে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করছেন।
ভিন্রাজ্য থেকে যে চালকেরা সংস্থায় যোগ দিয়েছেন তাঁদের মাথার উপর ছাদ তৈরি এবং সন্তানদের উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার চালানোর জন্য মূলত এই সঞ্চয় করছেন উথায়া।
সংস্থার মালিকানা হাতে থাকলেও উথায়া নিজেও গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে তুলে নেন। গাড়ি চালিয়ে তিনি দীর্ঘ দূরত্ব পেরিয়ে যান। যাত্রী নিয়ে কলকাতাতেও এসেছেন উথায়া। কোভিডে লকডাউনে ব্যবসা টিকে যায় এ ভাবেই। এই নিরলস চেষ্টা দিয়েই প্রতিটি বাধা পথের বাঁকের মতো মসৃণ গতিতে পেরিয়ে চলেছেন দক্ষিণী যুবক।