গত শতাব্দীর ৬০ এবং ৭০-এর দশকে ভারতের উপর মার্কিন গুপ্তচরদের ছিল কড়া নজর। দিল্লি এবং কলকাতার গোপন ডেরায় বসে যাবতীয় কাজকর্ম সারতেন তাঁরা। প্রায় ছ’দশক পর সেই তথ্য এ বার প্রকাশ্যে আনলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন খাতে বইবে কি না, আন্তর্জাতিক মহলে সেই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
চলতি বছরের ১৮ মার্চ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন ফিটজ়েরাল্ড কেনেডির হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত একাধিক গোপন নথি জনসমক্ষে এনেছে ট্রাম্প প্রশাসন। সেখানেই রয়েছে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএর কাজকর্ম সংক্রান্ত বহু গুপ্ত তথ্য। সংশ্লিষ্ট নথিগুলি প্রকাশ্যে আসতে চোখ কপালে ওঠে অনেকের।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে তাঁরই পূর্বসূরি কেনেডির হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত যাবতীয় ফাইল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে আমেরিকার জাতীয় সংরক্ষণাগার এবং নথি প্রশাসন (ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এনএআরএ)। এর পরই সংশ্লিষ্ট নথিগুলির কাটাছেঁড়ায় নামে দুনিয়ার তাবড় সংবাদ সংস্থা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেখান থেকে পাওয়া বেশ কিছু তথ্য এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) পোস্ট করে আন্তর্জাতিক রুশ বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম ‘আরটি অন’।
সমাজমাধ্যমে করা পোস্টে কেনেডি হত্যাকাণ্ডের ফাইলের একটি নথির ছবি তুলে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট রাশিয়ান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক। সেখানে রয়েছে ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর (কোল্ড ওয়ার) দশকগুলিতে সিআইএর গুপ্ত ঘাঁটিগুলির হদিস। মার্কিন গুপ্তচরদের নিউ ইয়র্কের দফতর থেকে সেগুলি পরিচালিত হত। সেখানে দিল্লি এবং কলকাতার পাশাপাশি নাম রয়েছে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি, শ্রীলঙ্কার কলম্বো, ইরানের তেহরান, দক্ষিণ কোরিয়ার সোল এবং জাপানের টোকিয়োর।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্রকাশিত হওয়া নথিগুলির মধ্যে কোথাও রাশিয়া বা চিনে সিআইএর কোনও গুপ্ত ঘাঁটির উল্লেখ নেই। উল্টে ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির উপরে নজরদারি চালানোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর ভরসার জায়গাটি আরও এক বার টোল খেয়েছে। এই গোপন আস্তানাগুলিতে বিনা বিচারে আটকে রাখার মতো অভিযোগও রয়েছে। ফলে আগামী দিনে সেগুলি আইনি তদন্তের আওতায় আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে অস্বস্তিতে পড়তে পারে ওয়াশিংটন।
আমেরিকার জাতীয় সংরক্ষণাগার এবং রেকর্ডস প্রশাসন জানিয়েছে, কেনেডি হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত মোট ২,২০০ ফাইল এবং ৬৩ লক্ষ নথি প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর ছবি এবং টাইপ করা তদন্ত সংক্রান্ত তথ্য। উল্লেখ্য, এর আগেও কেনেডি খুনের কিছু নথি জনসমক্ষে এনেছিল আমেরিকা। এ বার এই সংক্রান্ত সিংহভাগ নথি প্রকাশ করা হল বলে স্পষ্ট করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
তবে নথি প্রকাশের পর বার বার খবরের শিরোনামে এসেছে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’র সময় পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সিআইএর জাল। সেই সময় মার্কিন গুপ্তচরদের গোপন আস্তানাগুলির নাম ‘ব্ল্যাক সাইট’ রেখেছিল ওয়াশিংটন। সেখান থেকে চলত নজরদারি এবং গুপ্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ। কিছু ক্ষেত্রে সন্দেহভাজনদের গোপনে তুলে নিয়ে এসে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন সিআইএর এজেন্টরা।
মজার বিষয় হল, ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর সময় রাশিয়ার উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে ইউক্রেনকে কাজে লাগায় আমেরিকা। ওই সময় কিভ কিন্তু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নেরই অঙ্গ। কিন্তু তার পরও রুশ গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে মস্কোর নাকের ডগায় ইউক্রেনে ‘ব্ল্যাক সাইট’ তৈরি করতে সক্ষম হয় সিআইএ। কেনেডি হত্যাকাণ্ডের নথিতে এরও উল্লেখ রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে অবশ্য সিআইএর সম্পর্কের লম্বা ইতিহাস রয়েছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি নথি থেকে জানা গিয়েছিল, ১৯৬২ সালে চিনা ভূখণ্ডের উপর নজরদারির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়েছিল দিল্লি। এই কাজে ইউ-২ গুপ্তচর বিমান ব্যবহার করে সিআইএ। সেগুলিতে জ্বালানি ভরার জন্য ওড়িশার চরবাটিয়া বায়ুসেনা ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।
স্বাধীনতার পর দেশের গোয়েন্দা পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজতে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলে কেন্দ্র। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) ডিরেক্টর টিজি সঞ্জীবী কমিউনিস্ট চিনের উপর নজরদারি করতে সিআইএকে খোলাখুলি ভাবে সাহায্য করেন। ১৯৫০ সালে বেজিং তিব্বত দখল করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক আরও গভীর হয়। পরবর্তী দশকগুলিতে লামাভূমিতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিতে সিআইএর পাশে থেকেছে ভারত।
১৯৫৯ সালে মার্চে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আসেন সেখানকার প্রধান ধর্মগুরু দলাই লামা। তাঁর এই পলায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সিআইএর। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের পর আমেরিকার থেকে বেজিঙের ব্যাপারে আরও বেশি করে গোয়েন্দা সহায়তা পেয়েছে ভারত। সেই সম্পর্ক এখনও বজায় আছে বলেই মনে করে বিশেষজ্ঞমহল।
ফলে কেনেডি হত্যাকাণ্ডের গোপন নথিতে নয়াদিল্লি এবং কলকাতায় সিআইএর গুপ্ত ঘাঁটির উল্লেখ থাকলেও এই ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরার আশঙ্কা খুবই কম। তা ছাড়া নির্বাচনী প্রচারের সময় এই নথি প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তাঁর যুক্তি ছিল, এতে মার্কিন নাগরিকদের মন থেকে সরে যাবে ধোঁয়াশার পাহাড়।
১৯৬২ সালে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের (পড়ুন কিউবা মিসাইল ক্রাইসিস) সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে প্রায় পরমাণুযুদ্ধের উপক্রম হয়েছিল আমেরিকার। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে তখন ডেমোক্র্যাটিক দলের বছর ৪৫-এর কেনেডি। কোনওমতে অবশ্য পারমাণবিক লড়াই এড়াতে সক্ষম হন তিনি। ঠিক এক বছরের মাথায় এর জন্যেই কি তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল? প্রকাশ হওয়া নথিতে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
কেনেডি ছিলেন আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট। ডোয়াইট ডি আইজ়েনহাওয়ারের পর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এত কম বয়সে আর কেউ রাষ্ট্রপ্রধানের কুর্সি পাননি। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর টেক্সাসের ডালাসে স্ত্রীর পাশে বসেই গুলিতে খুন হন কেনেডি। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন একটি গাড়িতে, যার নাম ছিল ‘লিঙ্কন’।
কেনেডি খুনের তদন্তভার গিয়েছিল ‘ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ বা এফবিআইয়ের কাঁধে। আততায়ী রাইফেলের গুলিতে প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছেন বলে জানতে পারেন তাঁরা। ঘটনার কিছু ক্ষণের মধ্যেই লি হার্ভি অসওয়াল নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এফবিআই। অভিযুক্ত মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক সৈনিক বলে জানা গিয়েছিল।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এফবিআইয়ের হেফাজতেই মাত্র দু’দিনের মাথায় লি হার্ভিকে খুন করেন স্থানীয় নাইট ক্লাবের কর্তা জ্যাক রুবি। ফলে প্রকাশ্যে আসে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব। মুখ বন্ধ করতেই লি হার্ভিকে দুনিয়া থেকে সরানো হয়েছে বলে মার্কিন পত্রপত্রিকাগুলিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। যদিও তা উড়িয়ে দেন এফবিআইয়ের গোয়েন্দারা।
কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সত্য উদ্ঘাটনে ওয়ারেন কমিশন বসিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। এই কমিশনের রায়ে সাবেক প্রেসিডেন্টের খুনে একমাত্র লি হার্ভিকেই অভিযুক্ত করা হয়। তবে মার্কিন আমজনতা ওয়ারেন কমিশনের তদন্তকেও মান্যতা দিতে চায়নি। এ ব্যাপারে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাত ছিল বলে মনে করেন তাঁরা।
ক্ষমতায় থাকাকালীন নাগরিক অধিকার এবং রাজস্ব আইন তৈরির প্রস্তাব দেন কেনেডি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে সেগুলি পাশ করে আমেরিকার পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থায় অনেক বদল এসেছিল। ১৯৭০-এর দশকে কেনেডির বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে আলোকপাত করেন ইতিহাসবিদদের একাংশ। তাঁর খুনের সঙ্গে এর কোনও যোগ রয়েছে কি না, এ বার তা স্পষ্ট করতে পারবেন তাঁরা।