দুর্ভেদ্য কবচে ঢাকা পড়বে গোটা আমেরিকা! রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র তো কোন ছাড়, বর্ম ভেদ করে নাকি গলতে পারবে না একটা মাছিও! ইতিমধ্যেই সেই অত্যাধুনিক হাতিয়ার তৈরির কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুধু তা-ই নয়, এর জন্য বিপুল খরচের ফিরিস্তিও যুক্তরাষ্ট্রের ‘‘কংগ্রেস’-এর কাছে খোলসা করেছেন তিনি।
ট্রাম্প জমানায় তৈরি হতে চলা মার্কিন কবচের পোশাকি নাম ‘গোল্ডেন ডোম’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দাবি, এর সাহায্যে অনায়াসেই ঠেকানো যাবে হাইপারসোনিক (পড়ুন শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন) ক্ষেপণাস্ত্র। বর্তমানে রাশিয়া এবং চিনের মতো শত্রু রাষ্ট্রগুলির অস্ত্রাগারে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি থাকায় চিন্তায় ঘুম উড়েছে ওয়াশিংটনের।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথগ্রহণের পর চলতি বছরের ৪ মার্চ মার্কিন ‘কংগ্রেস’-এ ভাষণ দেন ট্রাম্প। সেখানেই প্রথম বার ‘গোল্ডেন ডোম’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে। এর জন্য ‘কংগ্রেস’-এর কাছে বিপুল অর্থ বরাদ্দের দাবিও জানান এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
বর্তমান বিশ্বের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলির মধ্যে ইজ়রায়েলের ‘আয়রন ডোম’-এর যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। গত দেড় বছর ধরে চলা পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে জাত চিনিয়েছে ইহুদিদের এয়ার ডিফেন্স। ‘গোল্ডেন ডোম’-এর ব্যাপারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ‘আয়রন ডোম’-এর প্রসঙ্গ টানেন ট্রাম্প। তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি আরও অত্যাধুনিক হবে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
‘কংগ্রেস’-এ ট্রাম্পের ভাষণের পর এই বিষয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরে তা খোলসা করেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ। রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে তিনি জানান, ‘‘ইজ়রায়েলি এয়ার ডিফেন্সের সঙ্গে অনেক জায়গাতেই পার্থক্য থাকবে মার্কিন গোল্ডেন ডোমের। এর মাধ্যমে কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক পুরু বর্মের আড়ালে থাকবে আমেরিকা।’’
এ বছরের ২৭ জানুয়ারি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ‘এগ্জ়িকিউটিভ’ নির্দেশে সই করেন ট্রাম্প। সেখানে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ার নির্মাণের রোড ম্যাপ ছকে ফেলতে ৬০ দিন সময়সীমা বেঁধে দেন তিনি। ‘গোল্ডন ডোম’-এর প্রস্তাবিত নকশার জন্য ‘লকহিড মার্টিন’-সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।
স্পেস নিউজ়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘গোল্ডন ডোম’-এর মাধ্যমে মহাকাশভিত্তিক ইনফ্রারেড লেজ়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে আমেরিকার। এর সাহায্যে হাইপারসোনিক, ব্যালেস্টিক এবং ক্রুজ়— তিন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে পারবে মার্কিন ফৌজ়। যুক্তরাষ্ট্রের স্থল এবং নৌবাহিনীকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেবে ট্রাম্পের সাধের ‘গোল্ডেন ডোম’।
মার্কিন মহাকাশ বাহিনীর ভাইস চিফ জেনারেল মাইকেল গুয়েটলিন জানিয়েছেন, এত দিন শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র কেবলমাত্র রাডারের সাহায্যেই চিহ্নিত করা হত। এ বার থেকে সেগুলিকে চিনিয়ে দেবে কৃত্রিম উপগ্রহ। এর পর ক্ষেপণাস্ত্রের রাস্তা খুঁজে নিয়ে মাঝ আকাশে সেগুলিকে লেজ়ারের সাহায্যে ধ্বংস করা হবে। এক কথায় এ ভাবেই অন্তরীক্ষ থেকে গোটা যুক্তরাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেবে ‘গোল্ডেন ডোম’।
শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিতকরণের জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবহার শুরু করায় মার্কিন সেনা রাডার ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করবে, এমন ভাবার কারণ নেই। লেজ়ারের পাশাপাশি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে প্রথাগত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিও চালু রাখবে তারা। অর্থাৎ, প্রয়োজনে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে শত্রুর মারণাস্ত্র ওড়াতে পারবে আমেরিকান ফৌজ।
জেনারেল গুয়েটলিনের কথায়, ‘‘পশ্চিম এশিয়ার ইজ়রায়েল এবং হামাস যুদ্ধ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। চিন এবং রাশিয়ার পাশাপাশি বর্তমানে ইরানও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে। আর তাই নিরাপত্তার খাতিরে এই ধরনের হাতিয়ারের প্রয়োজন হচ্ছে।’’ এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।
সূত্রের খবর, সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যেই ‘গোল্ডেন ডোম’-এর প্রযুক্তিগত প্রদর্শন করতে সক্ষম হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ২০২৯ সালের মধ্যে একে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোতায়েন করবে মার্কিন ফৌজ। ‘জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্প’-এর (ন্যাশনাল মিসাইল ডিফেন্স প্রোগ্রাম) আওতায় এই কবচ তৈরি করতে বদ্ধপরিকর ট্রাম্প প্রশাসন।
প্রসঙ্গত, ইজ়রায়েলের ‘আয়রন ডোম’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে মার্কিন ‘গোল্ডেন ডোম’-এর আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, ইহুদিদের অস্ত্রটি স্বল্পপাল্লার রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। এটি মূলত পরিচালিত হয় রাডার সিস্টেমের মাধ্যমে। মাঝ আকাশে রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে ‘আয়রন ডোম’-এ থাকা তামির নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ।
কোনও সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে ‘আয়রন ডোম’-এর নকশা তৈরি করেছেন ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এর সাহায্যে দেশের প্রতিটা কোণ সুরক্ষিত করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে গোটা আমেরিকাকে সুরক্ষিত করতে ‘গোল্ডন ডোম’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
প্রস্তাবিত মার্কিন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি একাধিক স্তরে আমেরিকার আকাশ একটি পৃথক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হবে বলে জানা গিয়েছে। এতে লেজ়ার অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ফলে খরচের দিক থেকে ‘আয়রন ডোম’-এর তামির ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় এটি সস্তা হবে বলে দাবি করেছেন সমর বিশেষজ্ঞেরা।
গত শতাব্দীর আশির দশকে ‘গোল্ডেন ডোম’-এর মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির স্বপ্ন দেখেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন। ওই সময় সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে জড়িয়ে ছিল আমেরিকা। ফলে মস্কো যখন-তখন আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম) দিয়ে হামলা করবে বলে আতঙ্কে ছিল ওয়াশিংটন।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রেগন। তাঁর সময়ে ‘গোল্ডন ডোম’-এর প্রযুক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হন আমেরিকান প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেলে একরকম বিপন্মুক্ত হয় ওয়াশিংটন। ফলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে ঠান্ডা ঘরে চলে যায় ‘গোল্ডেন ডোম’।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘ওরেশনিক’ নামের হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতেই ফের এক বার ‘গোল্ডেন ডোম’-এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। তা ছাড়া চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর হাতে থাকা আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলিও আমেরিকার ফৌজি জেনারেলদের চিন্তা বাড়িয়েছে।
বর্তমানে ‘টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড নামের একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে মার্কিন ফৌজ। এই হাতিয়ারটিও স্থানীয় ভাবে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত বছর থাড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ইজ়রায়েলকে ব্যবহার করতে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন।