এ যেন খাবারকে আরও সুস্বাদু করতে কাজু-কিশমিশ ঢেলে দেওয়া! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর সেই কাজটাই নিপুণ হাতে করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর দেখানো স্বপ্ন পূরণ হলে ‘আর্থিক বারান্দা’য় যুক্ত হবে ভারত ও আমেরিকা। মুম্বই থেকে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপ ছুঁয়ে সেই রাস্তা পৌঁছবে আটলান্টিকের অপর পারে।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৩ এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা সফরে যান প্রধানমন্ত্রী মোদী। রাজধানী ওয়াশিংটনের সুবিখ্যাত ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ (পড়ুন হোয়াইট হাউস) দীর্ঘ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন দুই রাষ্ট্রনেতা। পরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ট্রাম্প বলেন, ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোরকে (ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডোর বা আইমেক) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এই আর্থিক বারান্দাকে ‘ঐতিহাসিক বাণিজ্যিক’ রাস্তা বলেও অভিহিত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
মোদী-ট্রাম্প দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর প্রথামাফিক যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে অংশ নেন দুই রাষ্ট্রনেতা। সেখানেই আইমেককে ইউএসআইমেকে বদলে ফেলার কথা প্রথম বার বলতে শোনা গিয়েছে ট্রাম্পের গলায়। তাঁর কথায়, ‘‘মহান ঐতিহাসিক রাস্তাটা তৈরি করার জন্য আমরা (পড়ুন ভারত ও আমেরিকা) একসঙ্গে কাজ করব। এটা ভারত থেকে শুরু হয়ে ইজ়রায়েল ঘুরে যাবে ইটালি। সেখান থেকে আসবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।’’
ইউএসআইমেককে কী ভাবে গড়ে তোলা হবে, তাঁর রূপরেখাও খোলাখুলি ভাবে দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ‘‘ঐতিহাসিক এই বাণিজ্যপথে আমাদের অংশীদারেরা বন্দর ও রেলপথে যুক্ত থাকবে। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মজবুত করতে সমুদ্রের গভীরে বিছোনো হবে অনেক অনেক তার।’’
ইউএসআইমেক তৈরিতে বিপুল খরচ করতে ওয়াশিংটন যে প্রস্তুত, তা স্পষ্ট করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর কথায়, ‘‘প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা ইতিমধ্যেই কিছু খরচ করেছি। এটা আগামী দিনে আরও বাড়বে।’’ অন্য দিকে এই ইস্যুতে মুখ খোলেন প্রধানমন্ত্রী মোদীও। এই ধরনের আর্থিক বারান্দা এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভারত ও আমেরিকা কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এর পাশাপাশি ভারত, ইজ়রায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারি জোট আইটুইউটুকে (ইন্ডিয়া-ইজ়রায়েল-ইউএই-ইউএস) মজবুত করার লক্ষ্যে সওয়াল করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ একে ‘পশ্চিম এশিয়ার কোয়াড’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলা বাহুল্য, ইউএসআইমেক প্রকল্পে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে এই চারটি দেশ।
প্রসঙ্গত, আমেরিকার আগে ফ্রান্স সফরে যান প্রধানমন্ত্রী মোদী। রাজধানী প্যারিসেও আইমেক নিয়ে ‘বন্ধু’ তথা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরেঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। পরে এ প্রসঙ্গে মোদী বলেন, ‘‘ভারত, পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে কৌশলগত পণ্য বিশেষত জ্বালানি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মালপত্রের দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা নেবে এই আর্থিক বারান্দা।’’
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, আইমেকের কাজ ভারত এবং আমেরিকা যৌথ ভাবে এগিয়ে নিয়ে গেলে আখেরে লাভবান হবে নয়াদিল্লি। এতে অন্য উচ্চতা পাবে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য। অতি অল্প সময়ে ভারতীয় পণ্যকে পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে পৌঁছে দেবে এই আর্থিক বারান্দা। একই ভাবে আমদানির ক্ষেত্রেও সময় এবং খরচ দুটোই কমবে। সবচেয়ে বড় কথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বিকল্প রাস্তা পাবে ভারত।
২০২৩ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে এই আইমেক প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় সরকার। এর জন্য একটি সমঝোতা চুক্তি বা মউ সই করে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইটালি, ফ্রান্স এবং জার্মানি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির ব্যাপারে প্রথম দিন থেকেই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী আমেরিকা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই আইমেক গড়ে তোলার নেপথ্যে ওয়াশিংটনের রয়েছে অন্য অঙ্ক। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপকে এক সুতোয় বাঁধতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই নামের একটি প্রকল্প শুরু করেছে চিন। আর এর মাধ্যমে একের পর এক দেশে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে বেজিং। আর তাই পাল্টা চালে ড্রাগনভূমিকে বেকায়দায় ফেলত আইমেককে সামনে এনেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রকল্পের নীল নকশা অনুযায়ী, দু’টি পৃথক করিডোরের মাধ্যমে গড়ে উঠবে আইমেক। এর মধ্যে পূর্ব দিকের করিডোরটিতে সমুদ্রপথে উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে যুক্ত হবে ভারত। আর উত্তর দিকের করিডোরটিতে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে উপসাগরীয় দেশ। সেখান থেকে আবার আটলান্টিক ঘুরে পণ্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন ট্রাম্প।
রেল এবং সড়কপথে যুক্ত থাকবে এই আইমেক করিডোর। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, জর্ডন এবং ইজ়রায়েল হয়ে এগিয়ে যাবে ওই রেললাইন এবং রাস্তা। শেষে ইহুদিভূমির উত্তর দিকে বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইটালিতে পৌঁছবে পণ্য। রেলপথের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে তার বিছোনোর কাজ করতে হবে পশ্চিম এশিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে।
এ ছাড়া আইমেক করিডোরে পণ্য চলাচলের জন্য উন্নত করতে হবে ডিজিটাল যোগাযোগ। হাইড্রোজ়েন রফতানির জন্য এই আর্থিক বারান্দায় পাইপলাইন তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে। মউ অনুযায়ী, করিডোরটির মূল লক্ষ্যই হল সংযোগ বৃদ্ধি এবং পণ্য পরিবহণের খরচ হ্রাস। পাশাপাশি, কর্মসংস্থান তৈরি করা, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমানো এবং এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে রূপান্তরমূলক একীকরণ ঘটানোর উদ্দেশ্যও রয়েছে এই আর্থিক বারান্দার।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এই আর্থিক করিডোর তৈরির জন্য সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে চুক্তি করে ভারত। কিন্তু, তার পরও এর কাজ যে খুব একটা এগিয়েছে, তেমনটা নয়। প্রকল্পটি থমকে থাকার জন্য পশ্চিম এশিয়ায় গত দেড় বছর ধরে চলা ইজ়রায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধকেই দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইহুদিভূমিতে ঢুকে বড় আকারের হামলা চালায় ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্তাইনের গাজ়া এলাকার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। বেশ কয়েক জন ইজ়রায়েলি সৈনিক ও নিরীহ নাগরিককে পণবন্দি করে তারা। সঙ্গে সঙ্গে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
এই যুদ্ধে ভূমধ্যসাগরের কোলের গাজ়া ভূখণ্ডে মারাত্মক বিমান হামলা চালায় ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। ফলে একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ওই এলাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়ে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, গাজ়া পুনর্গঠনের কাজ করবে আমেরিকা। এর জন্য সেখানকার প্যালেস্তিনীয় নাগরিকদের অন্যত্র চলে যেতে বলেছেন তিনি। গাজ়ার শরণার্থীদের জায়গা দিতে জর্ডন এবং মিশরের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
এ বছরের জানুয়ারিতে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইজ়রায়েল। দু’পক্ষের মধ্যে চলছে বন্দি প্রত্যর্পণ। কিন্তু ট্রাম্পের ওই মন্তব্যের পর ফের জটিল হয়েছে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে হামাস। অন্য দিকে প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীদের নিজের দেশে নিতে নারাজ জর্ডন ও মিশর।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, আইমেককে ইউএসআইমেকে বদলাতেই গাজ়ার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভাবে নিজের হাতে তুলে নিতে চাইছেন ট্রাম্প। এর জন্য সেখানে মার্কিন সৈনিকদেরও পাঠাতে পারেন তিনি। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে হামাস পাল্টা প্রত্যাঘাতের রাস্তায় গেলে ফের রণক্ষেত্রে পরিণত হবে ওই প্যালেস্তিনীয় ভূখণ্ড।
আর তাই আইমেক প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তবে আংশিক ভাবে ভারত থেকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং সৌদি আরবের মধ্যে চালু হতে পারে এই আর্থিক বারান্দা। তাতেও পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিকল্প রাস্তা পাবে নয়াদিল্লি।