পরিবারের প্রত্যেকেই বিচারক, না হলে আইনজীবী। পেশার জন্যই এই পরিবারের দেশজোড়া খ্যাতি। প্রতিপত্তিও। সবাই জানেন, এই পরিবারের সদস্য মানে তিনি আইনের পাহারাদারই হবেন। তবে যা জানতেন না, তা হল এই পরিবারেরই এক সদস্যই আইনকে যথেচ্ছ ভেঙেছেন, নিজের সুবিধার্থে আইনকে যেমন খুশি ব্যবহার করে একের পর এক অপরাধও করে গিয়েছেন।
কী নেই সেই অপরাধের তালিকায়! খুন, খুনের বরাত দেওয়া, মাদক পাচার, মাদক সেবন— সব। তবে সম্প্রতি নিজের ২২ বছরের পুত্র এবং স্ত্রীকেও হত্যা করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ওই পরিবারের এক সদস্য। আপাতত সেই অপরাধের কী শাস্তি হয়, তা জানার জন্য আগ্রহ বেড়েই চলেছে আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলিনায়।
এ দেশে মারডফ পরিবারকে এক ডাকে চেনেন সবাই। অপরাধী সেই পরিবারেরই সন্তান। নাম অ্যালেক্স মারডফ। ৫৪ বছরের অ্যালেক্স নিজে একজন অপরাধ বিষয়ক আইনজীবী।
বছর খানেক আগে এই অ্যালেক্সেরই বাংলোর বাগান থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রের দেহ। নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাঁদের।
অ্যালেক্সের পুত্রের বয়স ২২। নাম পল মরডাফ। তাকে খুন করা হয়েছিল একটি শটগান দিয়ে। জীবজন্তু শিকার করতে ব্যবহার করার এই বন্দুকের গুলি লেগে পলের মাথার খুলি ফালা ফালা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাগানে।
অ্যালেক্সের স্ত্রী ম্যাগির দেহও পাওয়া গিয়েছিল কাছেই। রাইফেলের গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল তার শরীরে। মোট ৫টি গুলি লেগেছিল ম্যাগির। তবে নিজের ৫২ বছরের স্ত্রী এবং তরুণ পুত্রকে খুন করার কথা নিজে মুখে একবারও স্বীকার করেননি অ্যালেক্স।
আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলিনার আদালত সম্প্রতি অ্যালেক্সকে এই দু’টি খুনেই দোষী সাব্যস্ত করেছে। তবে অ্যালেক্সের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে প্রকাশ্যে এসেছে আরও দু’টি খুনের ঘটনা। একটি তাঁর পরিবারের পুরনো পরিচারিকার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা। অন্যটিতে এক যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায় অ্যালেক্সের বাংলো বাড়ির বাগানের বাইরে।
তদন্তকারীদের অনুমান, এই দুই খুনের ঘটনাতেও জড়িত ওই আইনজীবী। এমনকি, তদন্তে নেমে অ্যালেক্সের বিরুদ্ধে এক ভাড়াটে খুনিকে খুনের বরাত দেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।
তবে সেই প্রমাণ অ্যালেক্সকে দোষী প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে আদালতে অ্যালেক্সের বিপক্ষের আইনজীবী অভিযোগ করেছেন, পারিবারিক প্রতিপত্তি ব্যবহার করে দিনের পর দিন অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে এসেছেন অ্যালেক্স। তাতে যে তিনি বেশ সফল হয়েছেন, একের পর এক প্রমাণ লোপাটের ঘটনাই তার বড় প্রমাণ।
অ্যালেক্সের স্ত্রী-পুত্রের দেহ পাওয়া গিয়েছিল ২০২১ সালের ৭ জুন। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, নিজের গোপন জীবনের কথা প্রকাশ্যে আসতে পারে অনুমান করেই অ্যালেক্স খুন করেন তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন আইনি পরিষেবা দেওয়ার একটি সংস্থার মালিক অ্যালেক্স। তবে সেই সংস্থার তহবিল থেকে দিনের পর দিন কোটি কোটি ডলার সরিয়েছেন তিনি। এমনকি, মক্কেলদেরও প্রতারণা করে তাঁদের থেকেও নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ ডলার।
এত টাকা নিয়ে কী করতেন অ্যালেক্স। তদন্তকারীরা জেনেছেন, ওই অর্থ অ্যালেক্স ঢালতেন তাঁর এক মহার্ঘ নেশার পিছনে। ওপিয়োয়েড ড্রাগের নেশা করতেন তিনি। যার জোগান পেতে প্রতি সপ্তাহে অ্যালেক্সের খরচ পড়ত সপ্তাহে পঞ্চাশ হাজার ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা ৪ লক্ষ টাকারও বেশি।
তদন্তকারীদের ধারণা নেশার জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করতেই নিজেরই সংস্থার তহবিল তছরুপ করতে হত অ্যালেক্সকে। নিজেকে বাঁচাতে এবং প্রমাণ লোপাট করতে যোগাযোগ রাখতে হত অপরাধ জগতের অনেকের সঙ্গে। এমনকি, মাদক পাচারকারীদের অনেকের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল অ্যালেক্সের। আদালতে এই সমস্ত অভিযোগই কবুল করেছেন অ্যালেক্স। কিন্তু স্ত্রী এবং পুত্রকে হত্যার কথা মানেননি।
যে অস্ত্রে অ্যালেক্সের স্ত্রী-পুত্রকে খুন করা হয়েছিল সেই রাইফেল এবং শটগান খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তদন্তকারীরা জেনেছেন, অ্যালেক্সের পরিবারের অনেকেরই পশু-পাখি শিকারের শখ আছে। বন্দুকের বিপুল সংগ্রহ রয়েছে তাদের। এমনকি, অ্যালেক্সের ছেলে পলের কাছেই ছিল একটি শটগানও। সেই অস্ত্রটিও বাড়ি থেকে নিখোঁজ।
অ্যালেক্স যে মিথ্যা কথা বলেছেন তারও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ঘটনার সময় বাড়িতে না থাকার কথা জানালেও তা যে মিথ্যা দাবি, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে পলের ফোনে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ঘটনাটি ঘটার পাঁচ মিনিট আগেও নিজের বাড়ির সামনের বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন অ্যালেক্স। যদিও তদন্তকারীদের তিনি জানিয়েছিলেন, ঘটনার সময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন না।
দক্ষিণ ক্যারোলিনার আদালতে যখন এই মামলার শুনানি চলছে, তখন বেশ কয়েক বার কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গিয়েছিল অ্যালেক্সকে। যদিও আদালত তাঁকে স্ত্রী-পুত্রের হত্যার মামলায় দোষী সাব্যস্ত করলে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি অ্যালেক্স। তার মুখের একটি পেশিও কাঁপতে দেখা যায়নি বলে লিখেছে দক্ষিণ ক্যারোলিনার সংবাদমাধ্যমগুলি।
আপতত মারডফ পরিবারের এই সদস্য শাস্তির অপেক্ষায় দিন গুনছেন। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, দক্ষিণ ক্যারোলিনার নিয়মানুসারে ৫৪ বছরের অ্যালেক্সের অন্তত ৩০ বছরের জেল হতে পারে। আর সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাবাস।