US Nuclear Bomb

পলকে উবে যাবেন ছ’লক্ষ মানুষ! কেন আচমকা ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ পরমাণু বোমা বানাচ্ছে আমেরিকা?

আবারও পরমাণু বোমা তৈরি এবং তার পরীক্ষার ঘোষণা করেছে আমেরিকা। কেন নতুন করে এই মারণাস্ত্র তৈরিতে নজর দিল ওয়াশিংটন?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:০৭
Share:
০১ ২২

দু’বছর পেরিয়েও থামছে না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অন্য দিকে হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথি ও ইরানের সঙ্গে একাধিক ফ্রন্টে লড়ছে ইজ়রায়েল। যার জেরে রক্তাক্ত পশ্চিম এশিয়া। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ পরমাণু বোমা পরীক্ষার কথা ঘোষণা করেছে আমেরিকা। যা গত শতাব্দীর ‘শীতল যুদ্ধের’ (কোল্ড ওয়ার) সময়কার স্মৃতি ফেরাল বলে দাবি করেছেন বিশ্বের তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

০২ ২২

গত বছরের (২০২৩) ২৭ অক্টোবর নতুন করে অতি শক্তিশালী পরমাণু বোমা তৈরি এবং তা পরীক্ষার কথা ফলাও করে জানিয়ে দেয় ওয়াশিংটন। যার পোশাকি নাম ‘বি৬১-১৩’। আমেরিকার যাবতীয় পত্র-পত্রিকার দাবি, এ বার যে বোমাটির পরীক্ষা করা হবে তা জাপানের হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়ে ২৪ গুণ বড়। যদিও সেই পরীক্ষার দিনক্ষণ আটলান্টিকের পারের দেশটির প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের তরফে সরকারি ভাবে কিছু জানানো হয়নি।

Advertisement
০৩ ২২

১৯৪৫ সালের ৬ অগস্ট হিরোশিমায় পরমাণু হামলা চালায় আমেরিকা। মানব ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম আণবিক আক্রমণ। পেন্টাগনের বোমারু বিমান যে পরমাণু বোমাটি ওই জাপানি শহরের উপর ফেলছিল, তার সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘লিটল বয়’। এর তিন দিনের মাথায় ৯ অগস্ট নাগাসাকিতে দ্বিতীয় আণবিক হামলা হয়। আমেরিকার দ্বিতীয় পরমাণু বোমাটির নাম ছিল ‘ফ্যাট ম্যান’।

০৪ ২২

ওই আণবিক হামলার পর আত্মসমর্পণ করে জাপান। শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ওই সময়ে দু’টি পরমাণু হামলায় দেড় থেকে আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এ হেন ‘লিটল বয়’ বা ‘ফ্যাট ম্যানের’ চেয়ে ২৪ গুণ বড় আণবিক বোমার ধ্বংসক্ষমতা যে অনেকটাই বেশি হবে, তা বলাই বাহুল্য। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনুমান, যে জায়গায় ‘বি৬১-১৩’-র বিস্ফোরণ ঘটবে, সেখানকার ৮০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা ছ’লক্ষ বাসিন্দা চোখের পলকে উবে যাবেন।

০৫ ২২

এ ছাড়া ওই ব্যাসার্ধের বাইরের দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সমস্ত ইমারত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদেরও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। পরমাণুর তেজস্ত্রিয়তা যত দূর ছড়িয়ে পড়বে, তত দূর পর্যন্ত প্রায় কেউই বেঁচে থাকবেন না। তার পরও যাঁদের জীবন রক্ষা পাবে, তাঁরা ক্যানসারের মতো মারণরোগে আক্রান্ত হবেন।

০৬ ২২

পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে রাশিয়ার হাতেই রয়েছে সর্বাধিক আণবিক অস্ত্র। যার আনুমানিক সংখ্যা ৫ হাজার ৮৮৯। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের অস্ত্রাগারে আছে ৫ হাজার ২২৪টা পারমাণবিক বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র। তা হলে নতুন করে কেন ‘বি৬১-১৩’ তৈরির প্রয়োজন হচ্ছে পেন্টাগনের? নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও গুপ্ত অভিসন্ধি?

০৭ ২২

গত বছরের (২০২৩) ৭ অক্টোবর বিশ্বের একমাত্র ইহুদি দেশ ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালায় ইরানের মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন ‘হামাস’। যাতে প্রাণ হারান ১,২০০ আম নাগরিক। শুধু তা-ই নয়, বহু ইহুদিকে অপহরণ করে প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় নিয়ে যায় হামাস। এর পরেই ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইজ়রায়েল। সংঘাতে হামাসের সমর্থনে এগিয়ে আসে ইরানের মদতপুষ্ট আরও দুই সন্ত্রাসী সংগঠন ‘হিজ়বুল্লা’ ও ‘হুথি’। পাশাপাশি, ইহুদিদের খতম করতে সরাসরি আক্রমণ চালিয়েছে তেহরানও।

০৮ ২২

এই পরিস্থিতিতে খোলাখুলি ভাবে ইজ়রায়েলের সমর্থনে রণাঙ্গনে প্রবেশ ঘটেছে আমেরিকার। ভূমধ্যসাগরের দিক থেকে ইহুদি ভূমিতে যাতে কোনও আক্রমণ না হয়, তার জন্য সেখানে বিমানবাহী রণপোত ‘ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড’কে মোতায়েন করেছে পেন্টাগন। অন্য দিকে লোহিত সাগরের দিক থেকে হুথিদের হামলা ঠেকাতে সেখানে টহল দিচ্ছে ওয়াশিটনের বিমানবাহী যুদ্ধপোত ‘ইউএসএস আইজ়েনহাওয়ার’। এ ছাড়াও ওই এলাকায় আরও চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে আমেরিকা।

০৯ ২২

তবে এ ভাবে খোলাখুলি ইহুদিদের পাশে দাঁড়ানোর ‘চরম মূল্য’ ইতিমধ্যেই দিতে হয়েছে ওয়াশিংটনকে। গত অক্টোবরে সিরিয়ায় আমেরিকার সৈন্য ছাউনিতে এক সপ্তাহের মধ্যে ১৯টি হামলার ঘটনা ঘটে। যার নেপথ্যে হুথিদের হাত থাকার প্রমাণ মেলে। যার কয়েক দিনের মধ্যেই ইয়েমেনে ওই জঙ্গি সংগঠনের গুপ্ত ডেরায় স্টেলথ ‘বি-২ স্পিরিট’ বোমারু বিমান দিয়ে প্রত্যাঘাত শানায় পেন্টাগন।

১০ ২২

ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু বোমা তৈরিতে মন দিয়েছে আমেরিকা। কারণ, বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আণবিক হাতিয়ার তৈরির খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে ইরান। শিয়া মুলুকটি ওই মারণাস্ত্র তৈরি করে ফেললে ওয়াশিংটনের প্রায় সমস্ত শত্রুর অস্ত্রাগারেই শোভা পাবে পরমাণু হাতিয়ার। যার ফলে রাতের ঘুম উড়বে পেন্টাগনের।

১১ ২২

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ঠিক এই কারণে নতুন করে পরমাণু বোমা তৈরি করছে না আমেরিকা। পশ্চিম এশিয়ায় বন্ধু রাষ্ট্র ইজ়রায়েলের হাতে রয়েছে আণবিক মারণাস্ত্র। যা গাজ়ায় প্রয়োগ করে হামাসকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে ইহুদিরা। যাতে একেবারেই সায় নেই ওয়াশিংটনের। উল্টে সেখান থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পশ্চিম এশিয়ায় পরমাণু যুদ্ধ কখনই কাম্য নয়।

১২ ২২

সমর বিশ্লেষকদের কথায়, রাশিয়া ও চিন, এই দুই শত্রুকে ঘিরেই সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা আমেরিকার। সম্প্রতি ‘নিউক্লিয়ার পশ্চার রিভিউ’ নামের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা দফতর। সেখানে বলা হয়েছে, মস্কো ও বেজিং গোপনে গোপনে এমন সব পরমাণু হাতিয়ার তৈরি করেছে, যা একসঙ্গে আঘাত হানলে বিশ্ব মানচিত্র থেকেই মুছে যাবে আমেরিকা। ফলত, কিছুটা বাধ্য হয়েই নাকি ‘আত্মরক্ষার্থে’ বি৬১-১৩ তৈরি এবং তার পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে হোয়াইট হাউস।

১৩ ২২

নিউক্লিয়ার পশ্চার রিভিউ রিপোর্টে ২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়া ও চিনে থেকে আণবিক হামলার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও বলা হয়েছে, আগামী ১০ বছরে বেজিং আরও অন্তত ১০ হাজার পরমাণু হাতিয়ার তৈরি করবে। যা ওয়াশিংটনকে নতুন করে অতি শক্তিশালী আণবিক হাতিয়ার তৈরি এবং তার পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।

১৪ ২২

পেন্টাগন চিন ও রুশ হুমকির কথা বললেও সেটাই যে বোমা তৈরির মূল কারণ, এমনটা নয়। এই সিদ্ধান্তে মিশে আছে আমেরিকার ঘরোয়া রাজনীতি। আটলান্টিকের পারের দেশটিকে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে আণবিক হাতিয়ার অন্যতম ইস্যু হিসাবে বহু দিন ধরেই কাজ করে আসছে। উদাহরণ হিসাবে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগনের কথা বলা যেতে পারে।

১৫ ২২

১৯৮১ সালে হোয়াইট হাউসের কুর্সিতে বসেন রিপাবলিকান পার্টির রেগন। ভোটে পূর্বতন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। প্রচারে পূর্বসূরির আণবিক নীতির কড়া সমালোচক ছিলেন রোনাল্ড। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতায় এলে পরমাণু হাতিয়ারের সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। যা প্রবল জনসমর্থন পেতে তাঁকে সাহায্য করেছিল।

১৬ ২২

এ বছরের আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুযুধান দুই দল (রিপাবলিকান ও ডোমেক্র্যাটিক) পরমাণু নীতি নিয়ে জোর প্রচারে নেমেছে। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটরা বি৬১ -১৩ আণবিক বোমার শক্তির কথা বলে ভোট টানতে চাইছেন। রিপাবলিকানদের অবশ্য পছন্দ ‘বি৮৩-১’ নামের অন্য একটি পরমাণু হাতিয়ার। যার পরীক্ষা ও সংখ্যা বৃদ্ধির সওয়ালে ব্যস্ত রয়েছেন তাঁরা।

১৭ ২২

বারাক হুসেন ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বি৮৩-১ পরমাণু বোমাকে অবসরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ফের পেন্টাগনের অস্ত্রাগারে জায়গা পায় ওই আণবিক বোমা। এর পর জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে আবারও হিমঘরে চলে যায় বি৮৩-১।

১৮ ২২

আমেরিকার প্রাক্তন সেনাকর্তাদের আবার দাবি, আগের চেয়ে অনেক কম খরচে নতুন এই পরমাণু বোমাটি তৈরি করতে যাচ্ছে পেন্টাগন। এর জন্য ৮০ কোটি ডলার ধার্য করা হয়েছে। বর্তমানে ওয়াশিংটনের কাছে বি সিরিজের যে সব আণবিক বোমা রয়েছে, তার রক্ষণাবেক্ষণের খরচ হাজার কোটি ডলার বা তার বেশি বলে জানা গিয়েছে।

১৯ ২২

যদিও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, আসন্ন আণবিক পরীক্ষার নেপথ্যে রয়েছে আমেরিকার ‘পরমাণু কূটনীতি’। যা ব্যবহার করে পৃথিবীর প্রতিটা দেশের উপর এক রকম দাদাগিরি চালায় ওয়াশিংটন। রাশিয়া ও চিন ক্ষমতাবৃদ্ধিতে ওয়াশিংটনের সেই অহংয়ে ধাক্কা লেগেছে। যা ফেরত পেতে কোমর বেঁধেছে আমেরিকা।

২০ ২২

তবে ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তে অন্য বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি ‘নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি’ থেকে নাম প্রত্যাহার করেছে মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমেরিকা নতুন করে কোনও পরমাণু পরীক্ষা না করলে আমরাও সেই রাস্তা মাড়াব না।’’

২১ ২২

কিন্তু, এ বছর আমেরিকা পরমাণু পরীক্ষা চালালে সেই দৌড়ে নামতে পারে রাশিয়া। দুই দেশের দেখাদেখি ব্রিটেন, ফ্রান্স বা চিনেরও একই পথের পথিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা আণবিক যুদ্ধের দিকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

২২ ২২

সাম্প্রতিক অতীতে পরমাণু হাতিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে ভারতও। বর্তমানে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সংখ্যায় আণবিক অস্ত্র রয়েছে নয়াদিল্লির হাতে। আমেরিকার পরমাণু পরীক্ষা ইসলামাবাদকেও এই পরীক্ষার জন্য উৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement