ঘটনা তো কম ঘটেনি তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে! প্রেম, বিচ্ছেদ, অগুন্তি বান্ধবী, বলিউডের অলিখিত নিয়ন্ত্রক, অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনায় ফুটপাথবাসীর প্রাণ নেওয়া, কৃষ্ণসার হরিণ শিকার। সব মিলিয়ে যেন জীবন্ত রুপোলি পর্দা তিনিই! বসন্তের মতোই রঙিন! তবু ৫৫তম বছরটাই যেন সবচেয়ে ঘটনাবহুল সলমন খানের জীবনে। ‘প্রিয় সখী’ ক্যাটরিনা কইফ সাতপাক ঘুরে ফেললেন বয়সে ছোট ভিকি কৌশলের সঙ্গে। জন্মদিনের ঠিক আগের দিন সাপের কামড়ে হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী ‘ভাইজান’। শ্যালক আয়ুষ শর্মার দাবি, খানদানের বড় ছেলে নাকি ছাপোষা, মধ্যবিত্ত মানসিকতার! সত্যিই কি তিনি তাই?
সেলিম-সলমা খানের বড় ছেলে সলমন খান। দিওয়ার-এর বিখ্যাত সংলাপ ‘মেরে পাস মা হ্যায়’-এর জ্বলন্ত সংস্করণ। এখনও চোখে হারান মাকে। তাই সেলিম খান যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন হেলেনকে, অনেক দিন পর্যন্ত তাঁকে মা বলে মেনে নিতে পারেননি। বলিউড বলে, বাবার এই আচরণই নাকি তাঁকে বিয়ে-বিমুখ করে তোলার জন্য অনেকটা দায়ী!
মায়ের মতোই ভাল আঁকতে পারেন। গানও গাইতে জানেন। পড়াশোনায় কতটা মনোযোগী ছিলেন? বলিউড বলছে, মুম্বইয়ের বান্দ্রার সেন্ট স্ট্যানিসলাস হাই স্কুল থেকে ১২ ক্লাসের পড়াশোনা শেষ করেছেন সলমন। তার আগে তিনি কয়েক বছর গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া স্কুলে পড়াশোনা করেন।
সলমনের বাবা বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার জুটি সেলিম-জাভেদের সেলিম। স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেও বলিউডমুখী। হিন্দি ছবি ‘বিবি হো তো অ্যায়সি’-এ সলমনের প্রথম অভিনয়, ১৯৮৮ সালে। রেখা-ফারুক শেখ অভিনীত 'বিবি হো তো অ্যায়সি'-তে ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরের বছরই তিনি সফলতম নায়ক! সুরজ বরজাতিয়ার 'ম্যায়নে পেয়ার কিয়া'য় 'প্রেম'। বিপরীতে ভাগ্যশ্রী।
তারও আগে সলমন খান সফল মডেল। সঙ্গিনী সঙ্গীতা বিজলানি। দেশের প্রথম সারির পোশাক প্রস্তুতকারী সংস্থার হয়ে এক ফ্রেমে ধরা দিয়েছিলেন দু’জনে। প্রেমেও পড়েছিলেন। বলি পাড়ায় রটনা, বিয়ের কার্ড পর্যন্ত নাকি ছাপা হয়ে গিয়েছিল তাঁদের! কে পিছিয়ে এসেছিল সাতপাক ঘোরা থেকে? জানা যায় না। তবে সলমনের ‘প্রেম রোগ’ তখন থেকেই। এবং পাঁচ বছরের বড় সঙ্গীতা এখনও সলমনের খুব কাছের বন্ধু।
সঙ্গীতা বিজলানি চলে গেলেও প্রেম কিন্তু ছাড়েনি পর্দার ‘প্রেম’কে! ছবিতে এই নামেই বিখ্যাত সলমনের জীবনে এসেছিলেন পাকিস্তানি নায়িকা সোমি আলি। ‘বুলন্দ’ তাঁদের প্রথম অভিনীত ছবি। সেই ছবির আউটডোর শ্যুটিং হয়েছিল কাঠমাণ্ডুতে। তার পাহাড়ি পথের বাঁকে অপেক্ষা করছিল ভাইজানের নতুন ভালবাসা। টানা আট বছর সম্পর্কে ছিলেন তাঁরা। বলিউড বলে, এক মাত্র সোমিই নাকি ‘পাত্রী’ হিসেবে পছন্দ ছিল সলমনের। আর সোমির অভিযোগ, সলমনের এত বান্ধবী যে কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবেন! প্রায়ই নাকি তিনি সোনির বদলে অন্য কারও সঙ্গে ব্যস্ত থাকতেন। যা নায়িকা মেনে নিতে পারেননি। অতএব বিচ্ছেদ।
সোমি চলে গিয়েছেন। সলমন কিন্তু একা হননি। তাঁর জীবনে ততক্ষণে ফারিয়া আলম। তাঁর কথা যদিও কোনও দিন অভিনেতা স্বীকার করেননি। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে ঝড় তোলার মতো কোনও প্রেম যদি সলমন করে থাকেন, সেটি এক মাত্র ঐশ্বর্য রাইয়ের সঙ্গে। সঞ্জয় লীলা বনশালি-র ‘হম দিল দে চুকে সনম’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন তাঁদের সেই রসায়নের কথা। প্রাক্তন বিশ্বসুন্দরীকে চোখে হারাতেন 'ভাইজান'।
শুরুতে সারাক্ষণ আগলানো। পরে সেটাই সন্দেহ হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর মধ্যে। যা ঐশ্বর্য মেনে নিতে পারেননি। সলমনের হাত থেকে নিস্তার পেতে সাময়িক বিবেক ওবেরয়ের মোহেও মজেছিলেন। বলিউড জুড়ে তাঁদের বিয়ের গুঞ্জন! পাগলপারা সলমন। বিবেককে খুনের হুমকি, ঐশ্বর্যকে মারধর- কী করেননি! বলিউড সাক্ষী, সলমন কিন্তু কোনও নায়িকার জন্য এত আকুল ছিলেন না। তবু আটকাতে পারেননি রাই সুন্দরীকে। ১৪ বছর হল তিনি বচ্চন-বধূ।
রাই তাঁর ‘জান’কে কি ভুলতে পেরেছেন? সলমনকে কিন্তু মনের ব্যথা সামলাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। ঐশ্বর্য আর তাঁর সঙ্গে অভিনয় করবেন না, তা মানতে পারেননি 'প্রেম'। বদলে তিনি কলেজ ছাত্রী স্নেহা উল্লালকে খুঁজে এনে নায়িকা বানিয়েছিলেন। বলিউডকে উপহার দিয়েছিলেন ঐশ্বর্যর ‘হুবহু সংস্করণ’। এক ছবিতেই রাতারাতি জনপ্রিয় নায়িকা স্নেহা। ‘লাকি: নো টাইম ফর লাভ’-এ তাঁর বিপরীতে সলমন। ছবির গল্প, গান তুমুল জনপ্রিয়। বলিউড বুঝেছিল, সলমনের মনে কতটা জায়গা দখল করেছিলেন রাই!
এর পরেই কি ভাইজান একটু বেশি ‘দামাল’ হয়ে উঠেছিলেন? মত্ত অবস্থায় আচমকা গাড়ি চালিয়ে ফুটপাথে। তারই বলি নিরীহ ফুটপাথবাসী। ‘ওরা ফুটপাথে কেন শুয়ে থাকবে’-র মতো উদ্ধত বার্তা দেওয়া। কৃষ্ণসার হরিণ শিকার, সব মিলিয়ে পরপর কেলেঙ্কারি! তার জেরে কারাগারের পিছনেও কাটাতে হয়েছে তাঁকে। সারা দেশের তামাম মহিলাকুল সেই সময়ে কায়মনোবাক্যে চেয়েছিলেন, তাঁদের ‘প্রেম’ যেন অক্ষয় হয়।
সেই সময়ে সলমনের পাশে ছায়ার মতো ছিলেন ক্যাটরিনা কইফ। বিদেশিনী কন্যা যেন সলমনের ক্ষতবিক্ষত জীবনে প্রেমের প্রলেপ হয়ে এসেছিলেন। ক্যাটরিনা সলমনকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। বদলে বলিউডে শক্ত হয়েছে তাঁর পায়ের তলার জমি। সব দেখেশুনে সলমন-অনুরাগীরা তাঁকে ‘ভাবিজি’ বলে ডাকতে শুরু করেছিলেন। সবাই অপেক্ষায় ছিলেন, কবে চার হাত এক হবে? শুধু মাত্র ক্যাটের জন্য ইউলিয়া ভান্তুরকে কেউ সলমনের পাশে দেখতে, মানতে রাজি হননি!
ক্যাটরিনাও সদ্য ছেড়েছেন তাঁর হাত। বয়সে ছোট ভিকি কৌশল এখন তাঁর জীবনসঙ্গী। প্রেমিকার বিয়েতে দেশ ছেড়েছেন ভাইজান। কিন্তু উপহার দিতে ভোলেননি। স্বামীর উপহারকে ছাপিয়ে গিয়েছে প্রাক্তনের উপহার। একদা প্রেমিকাকে ৩ কোটি টাকা দামের গাড়ি উপহার দিয়েছেন তিনি।
৫৫ বছরের জন্মদিন বোধহয় জীবনে ভুলতে পারবেন না 'ভাইজান'। জন্মদিনের এক দিন আগেই সর্পাঘাতে শয্যাশায়ী। শনিবার মধ্যরাতে পানভেলে নিজের খামারবাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন সলমন। হঠাৎই হাতে ব্যথা। বন্ধুদের চোখে পড়ে সলমন যেখানে বসেছিলেন, একটি সাপ সেখান থেকে নেমে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হুলুস্থূল। চিৎকার করে সবাই সাহায্য চাইতে শুরু করেন। দেরি না করে নবী মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ‘ভাইজান’কে। রাত তখন ৩টে।
বসন্ত বাতাস যেমন এক নিমেষে ওলোটপালট করে দেয় সব কিছু, সলমনও যেন তেমন! ভরা শীতে জন্মেও সদা চঞ্চল। ক্ষণস্থায়ী প্রেম, কখনও প্রতিহিংসা পরায়ণ, পর ক্ষণেই দানবীর! সলমনকে চেনা গণ্ডিতে বাঁধা দায়! অতিমারিতে তিনি নিজে ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীদের হাতে রেশন তুলে দিয়েছেন। ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছেন নির্দিষ্ট অর্থ। আজ পর্যন্ত কেউ কোনও দিন তাঁর কাছে এসে খালি হাতে ফিরে যাননি।
তিনি দাতা, এ খবর জেনে এক মহিলা ছেলের পড়াশোনার জন্য ল্যাপটপ চাইতে এসেছিলেন। নিজের মহার্ঘ্য ল্যাপটপ তাঁর হাতে তুলে দেন ‘টাইগার'। তাঁর বাড়িতে সকলের সব সময়ে অবারিত দ্বার। পোশাক থেকে খাবার- সব সময়েই বাড়তি মজুত। সলমন নিজে ইদ পালন করেন। আবার গণেশ বন্দনাতেও মাতেন।
অতি সম্প্রতি ভগ্নীপতি আয়ুশ মুখ খুলেছেন তাঁর জামাইবাবুর হয়ে। কেন চিরকুমার থাকলেন ৫৫-র যুবক? আয়ুশের কথায়, বৈভবের মধ্যে থাকলেও সলমন নিতান্তই মধ্যবিত্ত, ছাপোষা। সেই মানসিকতার মেয়ের খোঁজ আজও তিনি পাননি। সবাই যে সলমনের বিত্ত-ই চায়। মানুষ সলমনকে চান ক'জন!