নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে ১১তম ওভারে ভারতীয় পেস বোলার উমরান মালিক কেন উইলিয়ামসনকে প্রথম যে বলটা করলেন, তার মুখোমুখি হওয়ার পর ব্যাটার যেন কিছুটা অপ্রস্তুত। বলের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার। পরের বলের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৪৫ এবং তার পরের বল করলেন ১৪৭ কিলোমিটার গতিবেগে। উপত্যকার এই বোলার তাঁর গতি আর আক্রমণ দিয়ে মনে করাচ্ছেন ‘রওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ শোয়েব আখতারকে।
উমরানের বল খেলার পর নিউ জ়িল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ম্যাচের শেষে উমরানকে তিনি বলেছেন, ‘অসাধারণ প্রতিভা।’ আসলে আইপিএলে তো উইলিয়ামসনের নেতৃত্বেই সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলেছেন উমরান। তাই আগে থেকে এই তরুণ বোলারের ভিতরে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন তিনি।
২০২১ সালের আইপিএলে প্রথম নজরে পড়েন জম্মু-কাশ্মীরের এই জোরে বোলার। টি নটরাজনের পরিবর্তে মাঠে নামা উমরান পুরোপুরি সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন। ১৫০ কিলোমিটার বেগে তাঁর একের পর এক ডেলিভারির জন্য উমরান আলাদা করে নজর কাড়েন।
২০২২ সালের আইপিএলে ১৪ ম্যাচ খেলে উমরানের শিকার ২২টি উইকেট। ‘বছরের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়’-এর পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। উপত্যকার এই বোলারের আগুনে ডেলিভারি নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা।
ভারতীয় ক্রিকেটে আঞ্চলিক ভাবে বরাবর পিছিয়ে জম্মু-কাশ্মীর। বস্তুত, গত ৬২ বছরের রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে মাত্র দু’বার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে জম্মু-কাশ্মীর।
তবে পেস বোলিংয়ে আলাদা করে আঞ্চলিক ক্রিকেটে নজর কেড়েছে উপত্যকা। ২০২১-’২২ সালে জম্মু-কাশ্মীর দলের ২১ সদস্যের স্কোয়াডে রয়েছেন মোট ৮ জন জোরে বোলার। তাঁদের মধ্যে অন্যতম উমরান।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, উপত্যকায় জোরে বোলার তৈরির আলাদা কারণ আছে। এবং সেটা পরিকাঠামোগত। ব্যাটিং এবং স্পিন বোলিংয়ের ক্ষেত্রে প্রচুর পরিকাঠামো দরকার। প্রয়োজন ভাল কোচের। কিন্তু জোরে বোলারের ক্ষেত্রে এ সব জরুরি নয়। সেখানে প্রয়োজন কেবল নতুন প্রতিভার। আর উপত্যকা সেটা দিয়ে এসেছে। উপত্যকার মানুষ জন প্রাকৃতিক কারণে শারীরিক ভাবে শক্তিশালী। এর নেপথ্যে রয়েছে তাঁদের খাদ্যাভ্যাসও।
সম্প্রতি ভারতে যে সব উঠতি জোরে বলার উঠে এসেছেন, তাঁদের অন্যতম জম্মুর গুজ্জর নগরের বাসিন্দা উমরান মালিক। উমরানের জন্ম ১৯৯৯ সালের ২২ নভেম্বর। ছোট থেকেই ক্রিকেটে প্রচণ্ড উৎসাহ তাঁর। এ কারণে দশম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা এগোয়নি।
উমরানের বাবা আব্দুল রশিদ পেশায় ফল বিক্রেতা। মা সংসার সামলান। উমরানের এক বড় বোন এবং এক ছোট ভাই আছেন। নিম্নবিত্ত পরিবার। এমন খেলার প্রতি ছেলের টানে একটু মুশকিলেই পড়েছিলেন রশিদ। তবে পরে উমরানের আগ্রহ দেখে নিজের সাধ্যমতো পাশে থেকেছেন বাবা।
৫ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা উমরানের বোলিংয়ের বিশেষত্বই হল গতি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার বেগেও বল করার রেকর্ড আছে তাঁর।
ছোট থেকে টুকটাক ক্রিকেট খেলতেন। তবে ১৭ বছর বয়স থেকে এই খেলাকেই নিজের পেশা করার কথা ভাবেন উমরান। একটি সাক্ষাৎকারে নিজেই সে কথা জানান। জম্মু-কাশ্মীর স্পোর্টস কাউন্সিলে খেলতে খেলতে নির্বাচকদের নজরে পড়েন।
তবে ভারতের এই স্পিডস্টার কেরিয়ারের প্রথম দিকে অমনোযোগী ছিলেন বলে সমালোচনা করেন কোচ। স্বপ্নপূরণ করতে হলে পরিশ্রম করতে হয়। শুধু প্রতিভা দিয়ে শীর্ষে পৌঁছনো যায় না। বার বার কোচের এমন বকুনিতে জীবনে নিয়মানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলা আনেন উমরান।
পাড়ায় ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট খেলা ছেলেটি আন্তর্জাতিক ব্যাটারদের যে ত্রাস হয়ে উঠতে পারেন, তা আগেই অনুমান করেছিলেন কোচ রণধীর সিংহ মিনহাস। এক দিন নেট প্র্যাকটিস করার সময় উমরানের দিকে নজর পড়ে প্রাক্তন উইকেটরক্ষক এবং অসমের কোচ অজয় রত্রার। এমন এক জন বোলার কেন জম্মু-কাশ্মীরের দলে নিয়মিত খেলেন না এ নিয়ে কয়েক বছর আগে সরব হন অজয়।
শুধু অজয়ই নন। উমরানে অনেক দিন আগে থেকে মুগ্ধ প্রাক্তন পেসার ইরফান পাঠানও। একটি সাক্ষাৎকারে ইরফান বলেন, ‘‘ওর বলের গতি আমাকে চমকে দিয়েছে। তবে আগে বল ডেলিভারির আগে অনেকটা লাফাত। ওকে এই অ্যাকশন পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম এতে সত্যিই বোলিংয়ের উন্নতি হয়েছে।’’
২০২১ সালে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে অভিষেক হয় উমরানের। পারভেজ রসুলের নেতৃত্বে ওই টি-টোয়েন্টি ম্যাচে রেলওয়ে দলের বিরুদ্ধে ভাল বোলিং করেন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি জেতে জম্মু-কাশ্মীর। ওই ম্যাচে উমরানের অবদানের প্রশংসা করেন অধিনায়ক। ফর্মে থাকা কর্ণ শর্মাকে সে ম্যাচে বোল্ড আউট করে ঝটকা দিয়েছিলেন উমরান।
এর এক মাস পর বিজয় হাজারে ট্রফিতে বাংলার বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পান উমরান। কিন্তু সেই ম্যাচে ভাল কিছু করতে পারেননি। ১০ ওভারে ৯৮ রান দিয়েছিলেন উমরান। এর পর উমরানের বড় সুযোগ আসে ২০২১ সালের আইপিএলে। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে উমরানের অসাধারণ বোলিং ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের নজর কাড়ে।
২০২২ সালে উমরানকে ৪ কোটি টাকায় কেনে সানরাইজ হায়দরাবাদ। ভালই বল করেছেন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ২০২২ সালের ২৬ জুন আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
মোট ৩টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। পেয়েছেন ২টি উইকেট। এক দিনের ক্রিকেটে অভিষেক হল নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ডেভন কনওয়েকে আউট করেন। এ পর্যন্ত দু’টি ওয়ান ডে ম্যাচে ২টি উইকেট শিকার করেছেন।
উমরানের বলের গতির জন্য অনেকেই তাঁর সঙ্গে প্রাক্তন পাক বোলার শোয়েব আখতারের তুলনা টানা শুরু করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে উপত্যকার এই বোলারের।
গত আইপিএলে বলের গতিতে চমকে দিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের এই তরুণ জোরে বোলার। গত শুক্রবার অকল্যান্ডেও বলের গতি দিয়েই আবার নজর কেড়েছেন তিনি।