তুষারপাতে প্রায় সব কিছুই ঝাপসা। তা-ও সঙ্গীদের পিছু পিছু সঙ্কীর্ণ পথে এগিয়ে চলেছেন মার্তা য়ুজকিভ। সকলের হাতেই অস্ত্র। নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন ফিসফিসিয়ে অথবা ইশারায়। আচমকা পিছন থেকে রাশিয়ান সেনাদের আক্রমণ। নিমেষে নিহত মার্তার চার সঙ্গী। মুহূর্তের মধ্যে একই অবস্থা হল মার্তারও। ইউক্রেনের এ দৃশ্য অবশ্য আসল নয়। রাজধানী কিভের বাইরে একটি পরিত্যক্ত কারখানায় এ ভাবেই দীর্ঘ দিন চলেছে গেরিলাযুদ্ধের মহড়া।
বৃহস্পতিবার ভোরে (স্থানীয় সময় ৬টা নাগাদ) রাশিয়ার আক্রমণের বহু আগে থেকেই গেরিলাযুদ্ধের মহড়া সেরে নিয়েছেন ইউক্রেনের স্বেচ্ছাসেবকেরা। চিকিৎসক, ট্যাক্সিচালক, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের পেশাদার, স্কুলশিক্ষক থেকে সাধারণ বধূ— রাশিয়ার সেনাদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে গেরিলাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছেন প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রের মানুষ। তাঁদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ যোদ্ধারা।
যুদ্ধের ময়দানে কোনও দিন নামেননি পেশায় চিকিৎসক মার্তা। কাজকর্মের শেষে তিন সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো এবং বাগানের পরিচর্য়া করতেই ভালবাসেন। তবে কখনও যদি রাশিয়ার আক্রমণের মুখে পড়ে ইউক্রেন? নিজের দেশকে বাঁচাতে গেরিলাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও রাজি ৫১ বছরের মার্তা।
মাস দুয়েক আগে একটি সংবাদমাধ্যমে মার্তা বলেছিলেন, ‘‘রাশিয়া আক্রমণ করলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাব না। রাশিয়ানদের শাসনে বাঁচতে চায় না ইউক্রেন। তাই সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলব। আমি সহানুভূতিশীল। তবে দেশকে রক্ষা করতে প্রাণ দিতেও পিছপা হব না।’’
খাতায়কলমে বৃহস্পতিবার থেকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তবে অনেক আগে থেকে ইউক্রেনের চারপাশে সেনাবাহিনীর জমায়েত করতে শুরু করেছিল ভ্লাদিমির পুতিন সরকার। গত ডিসেম্বরে যুদ্ধের সরঞ্জাম-সহ এক লক্ষ সেনা ঘিরে ধরে ইউক্রেনকে। অতিরিক্ত আরও ৭৫ হাজার সেনা তৈরি ছিলেন। শেষমেশ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতি যে আসতে পারে, সে নিয়ে ইউক্রেন সরকারকে সতর্ক করেছিল দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলি। সেই সতর্কবার্তা মেনে পুতিন-সেনার বিরুদ্ধে প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছিলেন ইউক্রেনের আম জনতা।
গত ডিসেম্বরে কিভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশিয়োলজি-র এক সমীক্ষায় দাবি, ইউক্রেনের ৫০ শতাংশের বেশি নাগরিক অর্থাৎ দু’কোটি মানুষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রস্তুত। তার মধ্যে ৩৩ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ৩০ লক্ষ আবার লড়াইয়ে স্বেচ্ছায় অস্ত্র তুলে নিতে রাজি।
গেরিলাযুদ্ধে পারদর্শী হতে ইউক্রেনের প্রায় ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক যোগ দিয়েছেন দেশের সেনাবাহিনীতে। খারকিভ থেকে এলভিভ— দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তের ওই স্বেচ্ছাসেবকেরা ইউক্রেনের ২৫টি ব্রিগেডে মহড়াও শুরু করে দিয়েছিলেন।
দেশ জুড়ে নানা প্রান্তেই সপ্তাহান্তে এক দিন জড়ো হয়ে চলত গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। অনেকেরই হাতে হয়তো আসল অস্ত্র থাকত না। তবে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়।
মার্তার মতোই গেরিলাযোদ্ধা হতে চান ৩৯ দিমিত্রো তারনোভস্কি। পেশায় ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট। কিভ আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৪ সালের রাশিয়ার আক্রমণের সময় অস্ত্র তুলে নিতে পারেননি। ডিসেম্বরে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে সেই আক্ষেপ মেটাতে চান। সাম্প্রতিক যুদ্ধে হয়তো রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে পেরেছেন দিমিত্রো।
২০১৪ সালে রাশিয়ার আক্রমণের সময় ইউক্রেনের কাছে মাত্র ছ’হাজার এমন সেনার দল ছিল, যাঁরা যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত। সে সময় থেকে রাশিয়ার মদতে পুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার জেরে ইউক্রেনে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ হাজার।
তবে পশ্চিমী দেশগুলির মদতে সেনাশক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। প্রেসি়ডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সেনাবাহিনী এই মুহূর্তে ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম। তাতে রয়েছেন দু’লক্ষ ৫৫ হাজার এমন যোদ্ধা, যাঁরা যে কোনও সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এ ছাড়াও ৯০ হাজার আধাসামরিক সদস্য-সহ ন’লক্ষ অতিরিক্ত সেনা রয়েছেন বাহিনীতে।
ওয়াশিংটনের দাবি, ইউক্রেনের সেনাকে শক্তিশালী করতে প্রতিরক্ষা খাতে আড়াই লক্ষ ডলারের অর্থসাহায্য করেছে জো বাইডেন সরকার। তার মধ্যে রয়েছে জ্যাভেলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল, হামভি গাড়ি, অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সরঞ্জাম-সহ সেনাদের অনুশীলনের ব্যবস্থায় সাহায্য।
যদিও যুদ্ধবিশারদদের দাবি, পুতিন-সেনার তুলনায় এখনও তেমন শক্তিশালী বা অভিজ্ঞ নয় ইউক্রেন। তবে চেষ্টার কসুর করেননি জেলেনস্কি সরকার।
রাশিয়ার আক্রমণের বহু আগে থেকেই দেশ জুড়ে বোমা-প্রতিরোধী প্রায় পাঁচ হাজার শেল্টারকে পুনরায় তৈরি রাখতে শুরু করে দিয়েছিল ইউক্রেন। তৈরি রাখা হয়েছিল মেট্রো স্টেশনগুলিও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যা মাটির কয়েকশো ফুট গভীরে গড়ে তোলা হয়েছিল। আচমকা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যাতে সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন ইউক্রেনীয়রা।
বৃহস্পতিবার যুদ্ধের আগে থেকেই শহর জুড়ে সাইরেন পরীক্ষা করতে শুরু করে দিয়েছিল কিভ প্রশাসন। আকাশপথে হামলায় সেগুলি যাতে সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায়। স্কুল, পানশালা, স্পা অথবা বড় বড় বিল্ডিংয়ের আশ্রয়স্থলগুলির মানচিত্রও আগেই প্রকাশিত করেছে প্রশাসন। কিভের এ সব জায়গায় ২০ লক্ষেরও বেশি বাসিন্দাদের নিরাপদে রাখার বন্দোবস্ত রয়েছে।