রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচে জেরবার হতে পারেন এ দেশের মধ্যবিত্তরা। পেট্রল-ডিজেল বা রান্নার গ্যাস-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম একলাফে অনেকটাই বাড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কী কী মহার্ঘ হতে পারে?
বৃহস্পতিবার ভোরে (স্থানীয় সময় প্রায় ৬টা নাগাদ) একটি টেলিভিশন-বার্তায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের কথা ঘোষণা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যদিও পুতিনের দাবি, ইউক্রেন দখলের জন্য এই সেনা অভিযান নয়। ইউক্রেনকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলমুক্ত করার লক্ষ্যেই অভিযান চালাবে রুশ সেনা।
তবে পুতিন সামরিক অভিযানের কথা বললেও ইউক্রেনের তিন দিক থেকে রুশ সেনাবাহিনীর হামলা শুরু করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল ডনবাস, দক্ষিণের ক্রাইমিয়া, বন্দর-শহর ওডেসা ছাড়াও বেলারুশ সংলগ্ন উত্তর ইউক্রেন— এই ত্রিমুখী আক্রমণের প্রভাব পড়েছে ভারতের বাজারেও।
রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের জেরে বৃহস্পতিবারই সোনার দাম চড়চড়িয়ে বেড়েছে। বৃহস্পতিবার এ দেশের বাজারে হলমার্কযুক্ত ২২ ক্যারাটের ১০ গ্রাম সোনার দাম ছুঁয়েছে ৫০ হাজার ৩০০ টাকা। ওই একই পরিমাণ ২৪ ক্যারাটের পাকা সোনার দাম হয়েছে ৫২ হাজার ২৫০ টাকা। গহনার সোনার দামও ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পৌঁছেছে (২২ ক্যারাট) ৪৯ হাজার ৫৫০ টাকা। গয়নাশিল্পের সঙ্গে যুক্তদের মতে, রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে।
সুদূর ইউক্রেনে যুদ্ধের আঁচে বিশ্ববাজারের পাশাপাশি প্রভাবিত হতে পারে দেশীয় অর্থনীতিও। এ দেশের মধ্যবিত্তের হেঁশেলেও তার প্রভাব পড়বে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০৫ ডলার ছুঁয়ে ফেলেছে। যা গত আট বছরে সর্বোচ্চ। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের বৃহত্তম উৎপাদনকারী হল রাশিয়া। তবে যুদ্ধের মধ্যে সেই জোগানে টান পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে বিশ্বের জিডিপি-তেও প্রভাব পড়বে।
এক অর্থনৈতিক সংস্থার দাবি, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অপরিশোধিত তেলের দাম শীঘ্রই ব্যারেল প্রতি দেড়শো ডলারে পৌঁছে যাবে। যার জেরে বিশ্বের জিডিপি নেমে যেতে পারে ০.৯ শতাংশ। একই হারে এ দেশেরও জিডিপি নিম্নমুখী হতে পারে।
বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে তাতে পাইকারি বাজারেও প্রভাব পড়বে। কী ভাবে? অর্থনীতিবিদেরা জানিয়েছেন, পাইকারি বাজারে ৯ শতাংশের বেশি দ্রব্যের সঙ্গে অপরিশোধিত তেলজাত পণ্যের সরাসরি যোগ রয়েছে। ফলে ওই দ্রব্যগুলির দাম বাড়বে।
মধ্যবিত্তের হেঁশেলে কী ভাবে টান পড়তে পারে? বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। যদিও এ দেশে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে ভোটের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার রান্নার গ্যাস-সহ পেট্রোপণ্যের দামে রাশ টেনে রেখেছে। তবে ৭ মার্চ উত্তরপ্রদেশে ভোটের পর যে ওই সব সামগ্রীও মহার্ঘ হতে চলেছে। তেমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
রান্নার গ্যাস (এলপিজি)-এর পাশাপাশি সিএনজি, পিএনজি-র মতো প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। এর জেরে বিদ্যুতের দামও বাড়তে পারে।
আগেও বহু বার দেখা গিয়েছে যে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার ফলে রান্নার গ্যাস ছাড়াও পেট্রল-ডিজেল বা কেরোসিনের দামে প্রভাব পড়েছে। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এ বারও এই পণ্যগুলির দাম বাড়বে বলে আশঙ্কা।
বস্তুত, দেশের মোট আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে ২৫ শতাংশই হল তেল। এই পণ্যের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় কেন্দ্রীয় সরকারকে। তেলের দাম বাড়লে দেশের মূলধনী ঘাটতিতেও প্রভাব পড়বে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, রাশিয়া হল বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় গম রফতানিকারী দেশ। অন্য দিকে, এই তালিকায় ইউক্রেন রয়েছে চতুর্থ স্থানে। ফলে কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধের জেরে রফতানিতে টান পড়লে গমের দামও বাড়তে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে এ দেশেও গমের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে।
গমের পাশাপাশি প্যালাডিয়াম নামে এক ধাতব পদার্থ রফতানিতেও শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া। মোবাইল ফোন-সহ অটোমোটিভ এগজস্ট সিস্টেমে এই ধাতু ব্যবহৃত হয়। তবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চেপেছে। এই আবহে ওই ধাতুরও দাম বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে মোবাইল ফোনের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।