এককালে রাতভর খোলা থাকত অভিজাত নাইটক্লাব, রেস্তরাঁ, ক্যাসিনো, পানশালা, স্ট্রিপ ক্লাবগুলি। তবে তা ছিল রুশ হানাদারির আগেকার কথা। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল কিভ তথা ইউক্রেনের নিশিঠেকগুলি। সম্প্রতি আবার সেগুলির দরজা খুলতে শুরু করেছে। যুদ্ধের মধ্যেই কি চেনা ছন্দে ফিরছে কিভ?
২৪ ফেব্রুয়ারির ভোরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে ইউক্রেনের বহু শহর। কিভেরও একই হাল। রুশ সেনাদের হামলার হাত থেকে বাঁচতে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গিয়েছিলেন কিভের বহু বাসিন্দা। শহর জুড়ে ব্যারিকেডের সারি। রাস্তায় সেনার বুটের আওয়াজ।
মাস ছয়েক পর কিভের ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে রুশদের আক্রমণ মূলত ইউক্রেনের পূর্ব প্রান্তে গিয়ে জমাট বেঁধেছে। ফলে দেশের উত্তর-মধ্য প্রান্তে থাকা কিভের ৩৫ লক্ষ বাসিন্দার অনেকেই ধীরে ধীরে নিজেদের বাড়িতে ফিরছেন।
কিভের মেয়র ভিতালি ক্লিটসকো জানিয়েছেন, মে মাসের মাঝামাঝি দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিক শহরে ফিরে এসেছেন। নাগরিকদের বাড়ির দরজার মতোই খুলছে নাইটক্লাব, রেস্তরাঁ, ক্যাসিনো, পানশালা, স্ট্রিপ ক্লাবগুলি। লোক জমতে শুরু করেছে অপেরা হাউস, থিয়েটার হল, আর্ট গ্যালারি, মিউজিয়াম, শপিং মলগুলিতেও।
মাসখানেক আগেও অবশ্য অন্য ছবি দেখা যেত। সব কিছু বন্ধ। খোলা থাকত শুধুমাত্র শপিং মল, সুপারমার্কেট এবং ওষুধের দোকানগুলি। কিভের রাস্তায় ইউক্রেনীয় সেনাদের আনাগোনা ছাড়া প্রায় দেখাই যেত না বাসিন্দাদের।
কিভের থেকে শত শত মাইল দূরে এখনও যুদ্ধ চলছে। তবে শহরের রাস্তাঘাট দেখে যুদ্ধের আঁচ পাওয়া মুশকিল। শহরজোড়া গাড়িঘোড়ার দাপটে আগের মতোই যানজট। রেস্তরাঁগুলিতে তিলধারণের জায়গা নেই। আর্ট গ্যালারিতে উদ্বোধন করা হচ্ছে নিত্যনতুন শিল্পকর্মের।
রুশ গোলাবারুদের ভয়ে ফেব্রুয়ারি-মার্চে যে স্ট্রিপ ক্লাবগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন কিভের নাগরিকেরা, সেগুলিও আবার ব্যবসায় ফিরেছে। বস্তুত, নিশিযাপনের জায়গা হিসাবে কিভের বেশ নামডাক রয়েছে।
এক সময় রাতভর খোলা থাকত কিভের স্ট্রিপ ক্লাবগুলি। প্যারিস হিলটনের মতো হলিউড তারকাও ইউক্রেন সফরে এসে এ শহরের নিশিঠেকে সময় কাটিয়ে গিয়েছেন।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মার খেয়েছে কিভের নিশিঠেকগুলির ব্যবসা। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এখনও রাত্রিকালীন কার্ফু চলছে। রাত ১০টা বাজলেই ক্লাব, রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ, রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলে কার্ফু। পুলিশি টহলদারি ছাড়া লোকজনের দেখা পাওয়া ভার।
কিভের পরিস্থিতি যে আগের অবস্থায় ফিরে আসছে, তার ইঙ্গিত দিচ্ছে নিশিঠেকগুলির ঢালাও বিজ্ঞাপন। গ্রাহকদের হাতছানি দিতে শহরের বিলবোর্ড জুড়ে তার ছবি ভেসে উঠেছে।
জুন থেকেই জমাটি আসর বসছে কিভের স্ট্রিপ ক্লাবগুলিতে। মধ্য কিভের বেসমেন্টে ‘পেন্টহাউস স্ট্রিপ ক্লাব’ও তার ব্যতিক্রম নয়। বেসমেন্টে ওই ক্লাবের দেওয়াল নিরাবরণ যুবতীর ছবিতে ছয়লাপ।
গত মার্চে ‘পেন্টহাউস স্ট্রিপ ক্লাবে’ আশ্রয় নিয়েছিলেন জনা তিরিশেক বাসিন্দা। ওলে বোদান নামে সেখানকার এক নিরাপত্তারক্ষী বলেন, ‘‘(যুদ্ধ শুরুর পর) এ ক্লাবের সমস্ত মেয়েরা চলে গিয়েছিল। আশপাশের অ্যাপার্টমেন্টগুলো থেকে লোকজন এখানে এসে ওঠেন। মাসখানেক পোষ্যদের নিয়ে এখানে ছিলেন তাঁরা।’’
যুদ্ধের জেরে ইউক্রেনে অসামরিক বিমান পরিষেবা বন্ধ। ফলে বিদেশি পর্যটকদের অভাবে কিছুটা হলেও মার খাচ্ছে স্ট্রিপ ক্লাবগুলির ব্যবসা। পর্যটনশিল্পে ধাক্কা লাগায় তার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। আগের মতো পসার জমাতে যে সময় লাগবে, তা বুঝতে পারছে ক্লাবগুলি।
যুদ্ধ, অর্থনীতির বেহাল দশা— এ সব সত্ত্বেও বাঁচার লড়াই থামাতে চান না নাতালি। স্ট্রিপ ক্লাবের ম্যানেজারি করে সংসার চলে তাঁর। সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের পদবি জানাতে চাননি তিনি। ব্যবসার বেহাল দশা নিয়ে নাতালি বলেন, ‘‘বুঝতেই পারছেন, লোকজনের মনমেজাজ ভাল নেই। তবে যে করেই হোক, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’’
পুতিনের বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের জয় নিশ্চিত, এমনই মনে করেন নাতালি। তিনি বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, আমাদেরই জয় হবে।’’
নাতালির মতোই আশাবাদী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও। সেই সঙ্গে কিভবাসীরা যে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, তাতেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন তিনি। জেলেনস্কি বলেন, ‘‘ওঁরা বেঁচে রয়েছেন। জীবন যে প্রবহমান, তার স্বাদও নিতে চান ওঁরা। আপনি তো সব সময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে বসে থাকতে পারেন না। এবং এটা আমাদের দেশের অর্থনীতির পক্ষেও সুখের কথা।’’