রাশিরা-ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যেই বেপাত্তা ব্রিটেনের ষষ্ঠ ধনী ব্যক্তি। হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না পুতিন-ঘনিষ্ঠ ব্রিটিশ ধনকুবের আলিশের উসমানভের। এমনই দাবি করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। তাদের আরও দাবি, ক্রোক করা হতে পারে উসমানভের বিপুল সম্পত্তি। তাই বেনামে লন্ডনের প্রায় ৫০৬ কোটির একটি প্রাসাদ বিক্রির চেষ্টায় রয়েছেন তিনি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের আরও দাবি, দেশ ছাড়তে উঠেপড়ে লেগেছেন ৬৮ বছরের উসমানভের স্ত্রী ইরিনা ভাইনের এবং ভাইপো সারভার ইসমাইলভও।
ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়ার উপরে ইতিমধ্যেই আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বিশ্বের বহু দেশ। ওই দেশগুলিতে পুতিন-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতদের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রীয় চোখরাঙানি চলছে বলে অভিযোগ।
এককালে উজবেকিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন আলিশের বুরখানোভিচ উসমানভ। সেখানকার রাজধানী তাসখন্দে ছোটবেলা কেটেছে। এর পর আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে স্নাতকস্তরের পড়াশোনার জন্য মস্কোয় গিয়েছিলেন। পড়াশোনার শেষে উজবেকিস্তানে ফিরে এসে সোভিয়েত শান্তি কমিটির ডিরেক্টর হিসাবে পেশাদার জীবন শুরু করেন। তবে গোড়াতেই বিপত্তি।
১৯৮০ সালে আর্থিক প্রতারণার দায়ে তাঁকে আট বছরের কারাবাসের সাজার ঘোষণা করে উজবেক সরকার। ছ’বছরের জন্য জেলেও ছিলেন তিনি। তবে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওই অপরাধ থেকে মুক্তি পেয়ে যান। ২০০০ সালে উজবেকিস্তানের শীর্ষ আদালত রায় দেয়, আর্থিক প্রতারণায় জড়িত ছিলেন না উসমানভ।
সাবেক সোভিয়েতের পতনের পর উসমানভের ভাগ্যও বদলে যায়। বিভিন্ন ধাতব খনির মালিকানা, মোবাইল ফোন, সংবাদমাধ্যম-সহ একাধিক ব্যবসা এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জেরে ফুলেফেঁপে ওঠেন তিনি। শোনা যায়, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ এক হাজার ৪০০ কোটি পাউন্ড।
টেলিকম এবং খনিশিল্প ছাড়া এককালে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব আর্সেনালের ৩০ শতাংশ মালিকানা ছিল উসমানভের। ২০১৮ সালে অবশ্য স্ট্যান ক্রোয়েঙ্কের কাছে তা বেচে দেন। বর্তমানে আরও এক ইপিএল ক্লাব এভার্টনে মোটা অঙ্কের অর্থের জোগানদাতা হিসাবে নাম রয়েছে উসমানভের।
তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলক সংস্থা গাজপ্রমের অধীনস্থ গাজপ্রম ইনভেস্ট হোল্ডিংও। ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই সংস্থার মালিক উসমানভ।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রতিপত্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রনেতা পুতিনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে উসমানভের। তবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর ব্রিটিশ সরকারের নজরে পড়ে যান উসমানভ-সহ ইগর শুভালভের মতো ধরকুবেররা। গত বৃহস্পতিবার উসমানভের সম্পত্তি ফ্রিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটেন ছাড়ায় নিষেধাজ্ঞাও চাপানো হয়। তবে উসমানভ এই মুহূর্তে কোথায়, তা-ই নাকি জানা যাচ্ছে না।
বিপুল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় নাকি একটি এস্টেট ম্যানেজারের মাধ্যমে উত্তর লন্ডনের হাইগেট এলাকায় তাঁর প্রাসাদোপম বাংলো বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উসমানভ। যদিও সে চেষ্টায় সফল হতে পারেননি তিনি। সরকারের দাবি, ওই বাংলোর মালিক এস্টেট এজেন্ট নন, খোদ উসমানভ।
ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছে, বিচউড হাউস-সহ সারেতে ষোড়শো শতকের সাটন প্লেস এস্টেট বিক্রি করতে পারবেন না উসমানভ। এমনকি, ওই বাংলোগুলির ধারেকাছেও যেতে পারবেন না তিনি।
যে প্রাসাদটি ঘিরে এত শোরগোল পড়ে গিয়েছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় যা ৫০৫ কোটি ৪৫ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬৮০ টাকা।
যদিও লন্ডনের ওই প্রাসাদটির মালিকানা ঘিরেও কম রহস্য নেই। ২০০৮ সালে বিচউড হাইস নামে ওই প্রাসাদটি প্রায় জলের দরে কিনেছিলেন উসমানভ। সে সময় তা কেনার জন্য উসমানভকে চার কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড খসাতে হয়েছিল। যদিও তার আগের বছরই গ্রেগোরিয়ান প্রাসাদটির বাজারদর ছিল সাড়ে ছ’কোটি পাউন্ড। সে সময়কালে লন্ডনের সবচেয়ে দামি স্থাবর সম্পত্তি।
১৮৪০ সালে তৈরি বিচউড হাউসের আসল মালিক কে? তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। জমি রেজিস্ট্রি করার সময় তার দলিলে ছিল, হেনলি লিমিটেড নামে একটি সংস্থা সেটি কিনেছে। তবে গত অক্টোবরে ওই সংস্থাটির ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে আট বেডরুমের ওই প্রসাদটি আসল মালিক এখন কে, তার সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, প্রাসাদের ভিতরে রয়েছে তিন বেডরুমের অতিথিশালা। প্রাসাদের কর্মীদের থাকার জন্য রয়েছে আটটি বেডরুম-সহ একটি স্কোয়াশ খেলার কোর্ট এবং ছ’টি ঘরের পুলহাউস।
বিচউড হাউস কেনার পর তা নাকি ভোলবদল করেছিলেন উসমানভ। মোশন ডিটেক্টরের প্রযুক্তি-সহ অত্যাধুনিক সিকিউরিটি ক্যামেরা দিয়ে প্রাসাদটি ঘিরে দিয়েছিলেন। ছিল থার্মাল এবং নাইট ভিশন ক্যামেরাও।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ১১ একরের ওই প্রাসাদের গায়েই রয়েছে হলিউড তারকা জুড ল এবং পপস্টার হ্যারি স্টাইলসের বাড়ি। এককালে জর্জ মাইকেল বা কেট মসের মতো তারকারও আশপাশেই থাকতেন।
শুধুমাত্র ধনকুবের ব্যবসায়ী হিসাবেই যে পুতিনের সঙ্গে উসমানভের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠেছিল, এমনটা নয় বলেও দাবি উঠছে। উসমানভের স্ত্রী ৭৩ বছরের ইরিনা ভাইন হলেন রাশিয়ার রিদ্যমিক জিমন্যাস্টিক্স দলের প্রধান কোচ।
২০০৪ সালের অলিম্পিক্সে ইরিনার কোচিংয়েই সোনা জিতেছিলেন আলিনা কাবেইভা। অনেকের দাবি, আলিনার অন্য পরিচয়ও রয়েছে। তিনি নাকি আসলে পুতিনের উপপত্নী।
ব্রিটিশ সরকারের নজরে সস্ত্রীক উসমানভ ছাড়াও রয়েছেন ভাইপো সারভার ইসমাইলভ। এভার্টনের প্রাক্তন ডিরেক্টর সারভারের বিরুদ্ধে গত বছরের জুনে লন্ডনের হাইড পার্ক গেট এলাকার একটি ফ্ল্যাটে এক ব্যক্তিকে শারীরিক নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছিল। তবে পরে প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যান তিনি। ২৬ বছরের সারভার আপাতত এভার্টনের মহিলা দলের স্পোর্টস অ্যান্ড কমার্শিয়াল ডিরেক্টর।