স্ত্রীকে নিয়ে ছুটি কাটাতে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিলেন জেফ্রি কিচেন। ছ’সপ্তাহ ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। লন্ডন থেকে বিমান নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সিঙ্গাপুরে আর জীবিত অবস্থায় যাওয়া হল না জেফ্রির। মাঝ আকাশে বিমানে প্রবল ঝাঁকুনির কারণে মৃত্যু হয় তাঁর।
লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ৩২১ বোয়িং বিমান। বিমানটিতে ২১১ জন যাত্রী এবং ১৮ জন বিমানকর্মী ছিলেন। ‘এয়ার টার্বুল্যান্সের’ কবলে পড়ে বিমানটি।
মাঝ আকাশে থাকায় যাত্রীদের অনেকেরই সিটবেল্ট বাঁধা ছিল না। ফলে ‘টার্বুল্যান্সের’ সময় সিট থেকে ছিটকে অন্য দিকে চলে যান যাত্রীরা। লাগেজও ছিটকে পড়ে এ দিক-ও দিক। সেই সময়ই মৃত্যু হয় ৭৩ বছর বয়সি জেফ্রির।
বিমান সংস্থার তরফে জানানো হয়, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয়েছে জেফ্রির। মঙ্গলবার ঘটনাটি ঘটেছে। ৩০ জন যাত্রী আহতও হয়েছিলেন। ‘টার্বুল্যান্সের’ পর ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানটি নামে। তড়িঘড়ি আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আহতদের মধ্যে রয়েছেন মৃত জেফ্রির স্ত্রী লিন্ডাও।
‘দ্য গার্ডিয়ান’ সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, জেফ্রি ব্রিস্টলের বাসিন্দা। থাকতেন গ্লুচেস্টাকশায়ারের থর্নবেরিতে। বিমা সংস্থায় কাজ করতেন তিনি। অবসর নেওয়ার পর নিজের শখ পূরণ করতেই ব্যস্ত ছিলেন জেফ্রি। তাঁর দিনের অধিকাংশ সময় কাটত থিয়েটার গ্রুপে।
থর্নবেরি মিউজ়িক্যাল থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জেফ্রি। এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ছোট থেকে গান-বাজনা, অভিনয়ের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। তাই অবসর নেওয়ার পর নিজের শখ নিয়ে মেতে থাকতেন তিনি।
সামনে রয়েছে থর্নবেরি মিউজ়িক্যাল থিয়েটার গ্রুপের দু’টি প্রযোজনা। এত দিন তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন জেফ্রি। তার মাঝে সময় বার করে স্ত্রীকে নিয়ে ছুটি কাটানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন। সেই মতোই সিঙ্গাপুরে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।
শুধু থিয়েটার নয়, একাধিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জেফ্রি। থর্নবেরির আর্মস্ট্রং প্রেক্ষাগৃহটি পুনরায় খোলার ব্যাপারেও উদ্যোগী হন তিনি। থিয়েটার গ্রুপগুলির সঙ্গে এই প্রেক্ষাগৃহের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। তবে একটা সময় সেই প্রেক্ষাগৃহে তালা পড়ে যায়। আবার তা খোলার জন্য যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন জেফ্রি।
সোমবার রাতে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুরগামী বিমানে উঠেছিলেন জেফ্রি। ছুটি কাটানোর আনন্দে বুঁদ ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। তাঁরা কেউই ভাবতে পারেননি, এ ভাবে বিষাদ গ্রাস করবে তাঁদের।
পরিবার সূত্রে খবর, জেফ্রি বেশ কয়েক দিন ধরেই হৃদ্রোগে ভুগছিলেন। সম্প্রতি তাঁর হৃদ্যন্ত্রে কিছু সমস্যা ধরা পড়েছিল। পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা দেখেন হৃদ্যন্ত্রে ব্লকেজ রয়েছে। অস্ত্রোপচারও হয় তাঁর। জেফ্রি বুকে স্টেন্টও বসানো হয়েছিল।
মঙ্গলবারের ‘এয়ার টার্বুল্যান্সের’ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স। একই সঙ্গে নিহত জেফ্রির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘‘বোয়িং বিমানে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে আহত হয়েছেন। বিমানে থাকা সকল যাত্রী এবং ক্রু সদস্যকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে।’’
কেন বিমানটি ‘টার্বুল্যান্সের’ মধ্যে পড়েছিল, তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে ‘টার্বুল্যান্সের’ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখনও তাড়া করছে যাত্রীদের। জানা গিয়েছে, মাত্র তিন মিনিটে আনুমানিক ছ’হাজার ফুট নেমে আসে বিমানটি।
ওই বিমানে থাকা এক যাত্রী ব্রিটিশ নাগরিক অ্যান্ড্রু ডেভিসকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলে, ‘‘সিটবেল্ট বাঁধা থাকায় আমার তেমন আঘাত লাগেনি। তবে আচমকাই চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যায়। চারপাশ থেকে চিৎকার, কান্নার শব্দ ভেসে আসতে থাকে। একই সঙ্গে যাত্রী জিনিসপত্র ছিটকে পড়ার শব্দও শুনতে পাই।’’
আর এক যাত্রী বললেন, ‘‘যাত্রা আরামদায়ক ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। নাটকীয় ভাবে আচমকাই বিমানটি হু-হু করে নীচে নামতে থাকে। যাঁদের সিটবেল্ট বাঁধা ছিল না, বিমানের ছাদের সঙ্গে তাঁরা ধাক্কা খান। ছিটকে পড়েন বিমানের মেঝেতে।’’
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এক কর্তার কথায়, প্রায় ১০ ঘণ্টা নির্বিঘ্নেই উড়েছিল এসকিউ৩২১ বোয়িং। যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন বিমানটি মায়ানমারের ইরাবতী অববাহিকার ৩৭ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ছিল। আচমকাই সেটি প্রায় ছ’হাজার ফুট নেমে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে কোনও বিমান এমন ‘টার্বুল্যান্সের’ কবলে পড়েনি। সিঙ্গাপুরের প্রশাসন আহত এবং নিহত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। সব রকম সাহায্য করার আশ্বাসও দেওয়া হয়।