তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। দু’জনের ‘অপরাধ’ই জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জুড়ে। দু’জনেই জেলবন্দি। গত শুক্রবার সংসদে শপথ গ্রহণ করে নজির গড়েছেন অমৃতপাল সিংহ এবং শেখ আব্দুল রশিদ।
পঞ্জাবের খলিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘ওয়ারিশ পঞ্জাব দে’-এর নেতা অমৃতপাল। ওই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং থানায় হামলা চালানোর অভিযোগে ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল পঞ্জাবের মোগা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
অমৃতসরের কাছে অঞ্জলা থানার লকআপে তিনি হামলা চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। জাতীয় সুরক্ষা আইনে (এনএসএ) গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। গ্রেফতারির পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় অসমে। তার পর থেকে ডিব্রুগড়ের একটি জেলে রয়েছেন অমৃতপাল।
পঞ্জাবের খাদুর সাহিব আসন থেকে ভোটে লড়েছিলেন অমৃতপাল। কংগ্রেসের কুলবীর সিংহ জিরাকে এক লক্ষ ৯৭ হাজার ১২০ ভোটে হারিয়েছেন তিনি। তাঁর সামনে কোনও বিরোধীই দাঁড়াতে পারেননি।
এ বারের লোকসভা ভোটে আর এক চমকের নাম আব্দুল রশিদ। তাঁকে ‘ইঞ্জিনিয়ার রশিদ’ নামেও চেনেন অনেকে। জম্মু ও কাশ্মীরের বারামুলা আসন থেকে এ বার জিতেছেন তিনি। হারিয়ে দিয়েছেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা তথা কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাকে।
রশিদের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের অর্থসাহায্য করার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ অগস্ট থেকে তিহাড় জেলে বন্দি তিনি। রশিদ দু’লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছেন ওমরের বিরুদ্ধে।
অমৃতপাল এবং রশিদ দু’জনেই নির্দল হিসাবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। জেল থেকেই দিয়েছিলেন মনোনয়নপত্র। এক দিনও নিজেদের হয়ে প্রচারের সুযোগ পাননি। মানুষ তবু ভোট দিয়েছেন তাঁদেরই। জয় নিয়ে অবশ্য আশাবাদী ছিলেন দু’জনেই।
জেলবন্দি প্রার্থীরা ভোটে জেতার পর তাঁদের শপথগ্রহণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হলেও আদৌ তাঁরা শপথগ্রহণ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল।
ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বা জিতলে লোকসভায় গিয়ে সাংসদ হিসাবে শপথগ্রহণ যে কোনও প্রার্থীর সাংবিধানিক অধিকার। তবে বন্দি হিসাবে এই দু’জনের ক্ষেত্রে আইনগত বাধা ছিল। শপথগ্রহণের জন্য তাঁরা জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেন।
সংবিধান মেনে শপথগ্রহণের জন্য জেল থেকে দুই জয়ী প্রার্থীকে প্যারোলে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। অমৃতপাল এবং রশিদ কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে শুক্রবার সংসদ ভবনে শপথবাক্য পাঠ করেন।
বন্দি হলেও নত হতে রাজি নন অমৃতপাল। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে নিজের মায়ের মন্তব্যেরও কড়া সমালোচনা করেছেন অমৃতপাল। তাঁকে খলিস্তানি বলার বিরোধিতা করে খাদুর সাহিবের সাংসদের মা বলেছিলেন, পঞ্জাবের অধিকারের জন্য লড়াই করলে কেউ খলিস্তানি হয়ে যায় না।
মায়ের এই মন্তব্য মানতে চাননি খোদ অমৃতপাল। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার মায়ের কথা শুনে আমি ব্যথিত। আমার বিশ্বাস, মা যা বলেছেন, না জেনে বলেছেন। কিন্তু আমার পরিবার থেকে এই ধরনের মন্তব্য আসা উচিত নয়। আমি শিখরাজের স্বপ্ন দেখি, এটা আমার অধিকার। বহু শিখ এর জন্য প্রাণ দিয়েছেন।’’
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতারির আগে অমৃতপাল বলেছিলেন, তিনি নিজেকে ভারতীয় বলে মনেই করেন না। তাঁর সে মন্তব্যেও বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল। সংবাদ সংস্থা এএনআইকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি নিজেকে ভারতীয় বলি না। আমার কাছে ভারতের পাসপোর্ট রয়েছে। সেটা ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় নথি মাত্র। পাসপোর্ট আমাকে ভারতীয় প্রমাণ করে না।’’
এখানেই শেষ নয়, অমৃতপাল বলতেন, তিনি ভারতের সংবিধানেও বিশ্বাস করেন না। ভোটে জিতে শপথ নেওয়ার পর অনেকে তাঁকে কটাক্ষ করে সেই পুরনো দৃষ্টান্ত টেনে এনেছেন। তাঁরা বলছেন, যে ব্যক্তি বলতেন তিনি দেশের সংবিধানে আস্থা রাখেন না, তাঁকেই সংবিধান মেনে সাংসদ হিসাবে শপথ নিতে হচ্ছে।’’
বার বার বিতর্কে জড়িয়েছেন কাশ্মীরের বারামুলার সাংসদ রশিদও। বিএসসি পাশ করার পর তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীরের সরকারি প্রকল্পে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করেছিলেন তিনি। সেই কারণেই ইঞ্জিনিয়ার রশিদ নামেও পরিচিত তিনি।
২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভার ভিতরে বিজেপি বিধায়কেরা রশিদকে আক্রমণ করেছিলেন। অভিযোগ, সরকারি দফতরের বারান্দায় তিনি গোমাংসের পার্টি আয়োজন করেছিলেন।
বিধায়ক থাকাকালীন রশিদ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, কাশ্মীর ভারতের অংশ নয়। তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল।
উধমপুরে কাশ্মীরি ট্রাক চালককে পিটিয়ে খুনের ঘটনার সমালোচনা করেছিলেন রশিদ। সে সময়ে তাঁর মন্তব্য নিয়েও বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। নয়াদিল্লিতে প্রেস ক্লাবের সামনে তাঁর মুখে কালি ছেটানোর অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। একাধিক বার ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ মন্তব্যের অভিযোগও উঠেছে রশিদের বিরুদ্ধে।
অমৃতপাল বা রশিদ— উভয়ের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ঘটনা এবং তাঁদের আচরণে বার বার একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। তাঁরা দেশের প্রচলিত নিয়মকানুন মানতে রাজি নন। ভারত ভেঙে তাঁরা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি করেন। ভারতীয় সংবিধানের ধারায় তাঁদের বাঁধা সম্ভব নয়।
ভোটে জিতে শপথ নিলেও সাংসদ হিসাবে কত দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন অমৃতপালেরা, তা স্পষ্ট নয়। শপথগ্রহণের জন্য সাময়িক ভাবে নির্দিষ্ট শর্তের অধীনে তাঁদের প্যারোল অনুমোদিত হয়েছিল। আদালত জানিয়েছিল, মুক্তি পেলেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না তাঁরা বা তাঁদের পরিবারের সদস্যেরা।
শপথের পর দুই সাংসদকেই লিখিত ভাবে স্পিকারকে জানাতে হবে, তাঁরা সংসদে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। অনুপস্থিত হিসাবে তাঁরা সংসদের সদস্য থাকতে পারেন কি না, ভোটাভুটির মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
তবে সাংসদ কোনও অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে এবং তাঁর দু’বছর বা তার বেশি দিনের জেল হলে সঙ্গে সঙ্গে সাংসদ পদ খোয়াতে হয়। অমৃতপাল এবং রশিদকে সাংসদ থাকতে হলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নিজেদের নির্দোষ প্রমাণিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কী হয়, সেটাই এখন দেখার।