ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের গা ঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম কালুওয়াড়া। তার তিন দিক ঘিরে আছে বিশাল শতদ্রু নদী। আর এক দিকে কাঁটাতার। বর্ষায় গোটা গ্রাম উপচে পড়ে শতদ্রুর জলে।
এই গ্রামের দুই কিশোরী করিনা কউর এবং কিরনা রানি। ১২ এবং ১৩ বছর বয়সি দুই মেয়ে যেন ইতিহাস লিখছে কালুওয়াড়ায়। রোজ একটু একটু করে তারা নিজেদের নাম গ্রামের ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখছে। হয়তো নিজেদের অজান্তেই।
কালুওয়াড়া গ্রামের জনসংখ্যা যৎসামান্য। মেরেকেটে ৫০ ঘর মানুষের বাস সীমান্তবর্তী এই গ্রামে। করিনা আর কিরনা সেই গ্রামে থেকেও গ্রামের গণ্ডি অতিক্রম করতে পেরেছে। প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে এখন তারা পড়ছে সেকেন্ডারি স্কুলে। গ্রামে আর কোনও মেয়ের এমন নজির নেই।
কালুওয়াড়াতে স্কুল যে একেবারেই নেই তা নয়। একটি ছোট্ট প্রাইমারি স্কুলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। তবে মেয়েদের মধ্যে বেশির ভাগই পঞ্চম শ্রেণি পাশ। তার পর আর পড়ার সুযোগ নেই ওই গ্রামে। সেই প্রতিকূলতাকেই জয় করেছে কালুওয়াড়ার দুই কন্যা।
পঞ্জাবের ফিরোজ়পুর জেলায় একটি সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে কিরনা আর করিনা। এক জন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, অন্য জন ষষ্ঠ শ্রেণির। প্রতি দিন তাদের স্কুলে যাওয়ার লড়াই রীতিমতো চমকপ্রদ।
কালুওয়াড়ার বাসিন্দাদের গ্রামের বাইরে যেতে হলে নৌকাই একমাত্র ভরসা। কিরনা আর করিনাও প্রতি দিন সকাল সকাল পিঠে ব্যাগ নিয়ে সেই নৌকায় চেপে বসে। কোনও কোনও দিন মাঝি জোটে। বেশির ভাগ দিনই নৌকা বাইতে হয় নিজেদের। লম্বা শক্ত দড়ি টেনে টেনে নদী পেরিয়ে যায় তারা।
শতদ্রুর জলে নিজেরাই নৌকা বেয়ে নিয়ে স্কুলে যায় দুই ছাত্রী। তাদের গ্রাম থেকে ছেলেরাও ওই একই স্কুলে যায়। স্কুলের প্রিন্সিপাল সতিন্দর সিংহ জানান, গ্রাম থেকে কেউ কেউ মোটরবাইক নিয়ে স্কুলে আসে। নদী পেরোনোর সময় নৌকাতেই মোটরবাইক তুলে নিতে হয়। বাইক-সহ কখনও কখনও উল্টেও গিয়েছে নৌকা। তবে এর আগে কালুওয়াড়া থেকে কোনও মেয়ে তাঁদের স্কুলে পড়তে এসেছে বলে মনে করতে পারেননি প্রিন্সিপাল।
তিনি বলেন, ‘‘আমি ৫ বছর এই স্কুলের দায়িত্বে রয়েছি। আগে কখনও কালুওয়াড়া থেকে এখানে কোনও মেয়েকে পড়তে আসতে দেখিনি। করিনা আর কিরনাই প্রথম। ওরা রোজ স্কুলে আসে। যখন শতদ্রু বর্ষার জলে উথালপাথাল, তখনও ওরা স্কুলে আসার চেষ্টা করে। গ্রামের ছাত্ররাও এত নিয়মিত স্কুলে আসে না।’’
রোজ সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বেরোয় দুই ছাত্রী। ৯টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছে যায়। কখনও কখনও ভাগ্য বিরূপ থাকে। নৌকা মেলে না। নদীর অপর পারে নৌকা থাকলে করিনাদের অপেক্ষা করতে হয় গ্রামে দাঁড়িয়ে। ও পার থেকে কেউ নৌকা বেয়ে এলে, তবে স্কুলে যেতে পারে দুই বন্ধু।
নদী পেরোনোর পরও স্কুলে পৌঁছনোর জন্য ৪ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয় তাদের। কাঁটাতার ঘেঁষেই দু’টি গ্রাম। পায়ে হেঁটে পেরিয়ে তবে স্কুলের দরজায় পৌঁছনো যায়। কিরনা বলে, ‘‘প্রথম প্রথম দড়ি টানতে আমার হাতে ব্যথা লাগত। এখন আর তা হয় না। গ্রামের লোকজনই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন কী ভাবে নৌকা বাইতে হয়, কী ভাবে ভারসাম্য ঠিক রাখতে হয়। এখন সব অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’’
স্কুলে গিয়ে ইংরেজি পড়তে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে, জানিয়েছে কিরনা। তারা যখন গ্রামে ফিরে আসে অন্য মেয়েরা পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করে তাদের কাছে। তাতে দারুণ আনন্দ হয় দু’জনেরই। কিরনা বলেছে, ‘‘আমি কখনও স্কুল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবিনি। আরও পড়াশোনা করে বড় হতে চাই। বাবা-মায়ের জন্য কিছু করে দেখাতে চাই।’’
বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায় ১৩ বছরের কিশোরী। কাঁটাতারকে খুব কাছ থেকে দেখেছে তারা। তাই সেনার লড়াইকেই নিজেদের পেশা করে তুলতে চায়। তাতে সায় আছে তাদের অভিভাবকেরও।
কিরনার মা শিন্দর কৌর বলেন, ‘‘আমরা চাই আমাদের মেয়ে আরও পড়াশোনা করুক। ওরা সকাল ৭টায় বেরিয়ে যায়। কখনও কখনও ৬টায়। ফিরতে ফিরতে বিকেল ৫টা বাজে। আমাদের ভয় করে। কিন্তু আর তো কোনও উপায় নেই।’’
স্কুল নিয়ে করিনার উৎসাহও কম নয়। সে বলেছে, ‘‘স্কুলে যাওয়ার কোনও একটা রাস্তা থাকলে অনেক ভাল হত। নৌকা বেয়ে স্কুলে যাওয়ার চেয়ে হাঁটা অনেক সহজ।’’ তবে স্কুল ছাড়ার কথা সে-ও কখনও ভাবেনি। পড়াশোনা করে আরও বড় হওয়াই তার লক্ষ্য।
বর্ষায় শতদ্রু নদীর জল ঢুকে পড়ে করিনাদের গ্রামে। তখন ঘরে থাকা যায় না। বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে উঠে পড়তে হয় গাছে। জল নামলে আবার গাছ থেকে নীচে নেমে আসেন সকলে। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও স্কুলে যাওয়া ছাড়তে পারেনি দুই বন্ধু। তাদের অদম্য এই জেদকে কুর্নিশ জানিয়েছে কালুওয়াড়াবাসী।