Turkey Mass Protest

বিরোধী নেতার গ্রেফতারিতে উত্তাল পাকিস্তানের ইউরোপীয় বন্ধু! গণবিক্ষোভে কুর্সি হারাবেন ‘তরুণ তুর্কি’?

প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোগানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে পরিচিত ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোগলু গ্রেফতার হতেই গণবিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে তুরস্ক। এ বার কি তবে সেনা অভ্যুত্থানের মুখে পড়বে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫ ০৭:১৮
Share:
০১ ২১
Turkey Mass Protest

বিরোধীদের বিক্ষোভে উত্তাল তুরস্ক। সূত্রের খবর, গণ আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ার আশঙ্কায় বিমানে দেশ ছেড়ে চম্পট দিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোগান। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও ঘোষণা করেনি আঙ্কারা। ফের কি তবে সেনা অভ্যুত্থানের মুখে পড়তে চলেছে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’? না কি বাংলাদেশের মতো জনরোষে রাজপাট হারাবেন এর্ডোগান? চর্চায় চলে এসেছে একাধিক প্রশ্ন।

০২ ২১
Turkey Mass Protest

গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে তুরস্কের কুর্সিতে রয়েছেন এর্ডোগান। ক্ষমতা ধরে রাখতে রাতারাতি সেখানকার আইন পাল্টেছেন তিনি। এই আইনকে ঢাল করে প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রেসিডেন্ট পদ বাগিয়ে নেন ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ বা একেপির প্রতিষ্ঠাতা। ২০২৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে তুরস্ক শাসন করার কথা রয়েছে তাঁর।

Advertisement
০৩ ২১
Turkey Mass Protest

এ-হেন সত্তরোর্ধ্ব এর্ডোগান ক্ষমতাচ্যুত হলে তাকে ‘ইন্দ্রপতন’ হিসাবেই দেখবে গোটা বিশ্ব। এতে পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক সমীকরণ পুরোপুরি বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আঙ্কারার সঙ্গে অন্য খাতে বইতে পারে রাশিয়া, ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক। পাশাপাশি, এর্ডোগান যে পুরনো অটোমান সাম্রাজ্য তৈরির স্বপ্ন দেখেছেন, তাতে অবশ্যই দাঁড়ি টানবে তুরস্ক।

০৪ ২১

তুর্কি দেশের সবচেয়ে বড় শহর হল ইস্তানবুল। আঙ্কারার সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘আনাদোলু এজেন্সি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৯ মার্চ সেখানকার মেয়র তথা বিরোধী দল ‘রিপাবলিকান পিপল্‌স পার্টি’ (সিএইচপি) নেতা একরেম ইমামোগলুকে গ্রেফতার করে এর্ডোগান প্রশাসন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’-এর অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে গণবিক্ষোভ।

০৫ ২১

উল্লেখ্য, তুরস্কের রাজনীতিতে ইস্তানবুলের মেয়র পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত এই কুর্সিতে ছিলেন এর্ডোগান। বস্তুত মেয়র হওয়ার পরই দেশ জুড়ে জনপ্রিয়তা হু-হু করে বাড়তে থাকে তাঁর। এর উপর ভর করে ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। টানা ১১ বছর সংশ্লিষ্ট পদে থেকে আইন বদলে ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেশের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন একেপির এই বর্ষীয়ান নেতা।

০৬ ২১

কিন্তু গত এক দশকে এর্ডোগানের বিরুদ্ধে নানা কারণে সাধারণ তুর্কিবাসীর বেড়েছে ক্ষোভ। সেই জায়গায় তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে এসেছেন সিএইচপির ইমামোগলু। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তায় কুর্সি হারানোর ভয় পেতে শুরু করেছেন পোড়খাওয়া একেপির বর্ষীয়ান নেতা। আর তাই অঙ্কুরেই শত্রুর বিষদাঁত ভাঙতে উঠেপড়ে লেগেছেন এর্ডোগান।

০৭ ২১

‘আনাদোলু এজেন্সি’ জানিয়েছে, ইমামোগলু-সহ মোট ১০০ জন বিরোধী নেতা-নেত্রীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে তুরস্ক প্রশাসন। ১৯ তারিখ ভোরে ইস্তানবুলের বাড়ি থেকে মেয়রকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া ইমামোগলুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুরাত অনগুন এবং আরও দু’টি জেলার মেয়রকে আটক করে পুলিশ। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ফুঁসে ওঠে জনতা।

০৮ ২১

গ্রেফতারের আগে অবশ্য সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেন ইমামোগলু। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘এর্ডোগানের অত্যাচার দিনের পর দিন সহ্য করতে হচ্ছে। এটা আর মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সরকার কখনও মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।’’ এই গ্রেফতারিতে তিনি যে প্রেসিডেন্ট-বিরোধিতা থামাচ্ছেন না, তা স্পষ্ট করেছেন ইস্তানবুলের মেয়র।

০৯ ২১

ইমামোগলুকে হেফাজতে নেওয়ার পর গণবিক্ষোভ ঠেকাতে ইস্তানবুলের বেশ কয়েকটি রাস্তা বন্ধ করে দেয় তুর্কি প্রশাসন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। মেয়রের সমর্থক তথা সিএইচপির কর্মীরা পুলিশের প্রধান কার্যালয় ঘিরে ফেলে। আন্দোলনকারীদের প্রায় প্রত্যেকের হাতে ছিল ইমামোগলুর ব্যানার-পোস্টার। পুলিশের সামনেই লাগাতার স্লোগান দেন তাঁরা। কেউ কেউ আবার বাতাসে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়েও প্রতিবাদ জানান।

১০ ২১

এর পরবর্তী পর্যায়ে শহরের সিটি হলের সামনে বিক্ষোভকারীদের ভিড় বাড়তে থাকে। সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন বিরোধী দল সিএইচপির নেতা ওজগুর ওজ়েল। সরকারি তরফে সেনা অভ্যুত্থানের চক্রান্ত হচ্ছে বলে সরাসরি অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘‘জনগণের ইচ্ছাকে জোর করে দখল করতেই এই সেনা অভ্যুত্থানের নীল নকশা ছকেছে এর্ডোগান প্রশাসন।’’ তাঁর এই মন্তব্যে আরও তেতে ওঠেন বিক্ষোভকারীরা।

১১ ২১

ওজ়েলের অভিযোগ, সেনা অভ্যুত্থানকে যুক্তিগ্রাহ্য হিসাবে তুলে ধরতে বিচার বিভাগকে কাজে লাগানো হয়েছে। যদিও তা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন তুর্কি আইনমন্ত্রী ইলমাজ় টুঙ্ক। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘ইস্তানবুলের মেয়রের গ্রেফতারের সঙ্গে সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই। বিচার বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট এর্ডোগানের নাম জড়িয়ে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা হচ্ছে।’’

১২ ২১

কিন্তু, তার পরেও ইমামোগলুর গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণার কথা ছিল। অন্য দিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে এর্ডোগান ফের সংবিধান সংশোধন বা আগাম নির্বাচনের রাস্তায় হাঁটবেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে তুরস্কের অর্থনীতি।

১৩ ২১

সম্প্রতি ইস্তানবুলের শেয়ার বাজারে প্রায় সাত শতাংশের পতন দেখা গিয়েছে। ডলারের নিরিখে সাড়ে তিন শতাংশ নেমেছে সেখানকার মুদ্রা লিরার দাম। ফলে একরকম খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে তুর্কি অর্থনীতি। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আঙ্কারাকে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের (ইন্টারন্যাশনাল মরিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) কাছে ফের হাত পাততে হতে পারে, বলছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

১৪ ২১

এই অবস্থায় তুর্কিবাসীর মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ফেরি করতে শুরু করেন ইমামোগলু। কিন্তু, তার আগেই তিনি ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ওঠে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। তা ছাড়া মেয়র নির্বাচনে বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা পিকেকের সরাসরি সাহায্য নেন তিনি। কুর্দদের এই নিষিদ্ধ সংগঠনটিকে অনেক দিন আগেই সন্ত্রাসবাদী অ্যাখ্যা দিয়েছে এর্ডোগান প্রশাসন।

১৫ ২১

ইস্তানবুলের মেয়রের বিরুদ্ধে বর্তমানে তদন্তে নেমেছে তুরস্কের আর্থিক দুর্নীতি দমন শাখা ‘হ্যাবেরতুর্ক’। একটি নির্মাণকারী সংস্থাকে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ আদালত থেকে পেয়েছে তারা। এই কোম্পানির আংশিক মালিকানা ইমামোগলুর বলে জানা গিয়েছে। যদিও তা অস্বীকার করেছেন তিনি।

১৬ ২১

সিএইচপির চেয়ারম্যান ওজ়েল অবশ্য জানিয়েছেন, এই গ্রেফতারির জন্য দলের ভিতরের নির্বাচন বন্ধ থাকবে না। আগাম ঘোষণা মতোই যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন তাঁরা। সেই সঙ্গে চলবে গণ আন্দোলন। ইস্তানবুলের মেয়রের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়েছে কুর্দপন্থী ‘পিপল্‌স ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি পার্টি’।

১৭ ২১

প্রসঙ্গত, গ্রেফতারির এক দিন আগে ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ইমামোগলুর ডিপ্লোমা ডিগ্রি বাতিল করে প্রশাসন। আঙ্কারার আইন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে গেলে এই ডিগ্রি আবশ্যক। ১৯৯০ সালে উত্তর সাইপ্রাসের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগে স্থানান্তরিত হন ইমামোগলু। নিয়ম মেনে এই বদল হয়নি বলে উঠেছে অভিযোগ।

১৮ ২১

এ ছাড়া সিএইচপির নেতার বিরুদ্ধে বিরোধী পরিচালিত পুরসভাগুলিতে চলা বিচার বিভাগীয় তদন্তকে প্রভাবিত করার অভিযোগও রয়েছে। এতে জেল বা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারেন তিনি। ২০২২ সালে তুরস্কের সুপ্রিম ইলেকটোরাল কাউন্সিলের এক সদস্যকে অপমান করায় সাজা হয় তাঁর। সেখান থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানিয়েছেন ইস্তানবুলের মেয়র।

১৯ ২১

২০১৯ সালের মার্চে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচনে ইমামোগলুর কাছে বড় ধাক্কা খায় এর্ডোগানের দল। প্রায় পাঁচ দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা একেপিকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করেন তিনি। এর পরই ভোটে কারচুপি হয়েছে বলে নির্বাচন বাতিলের চেষ্টা করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। কয়েক মাসের মধ্যেই ফের ভোট হয় সেখানে। এ বারও কুর্সি ধরে রাখতে সক্ষম হন বছর ৫৫-র ইমামোগলু।

২০ ২১

গত কয়েক দশক ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগ দিতে চাইছে তুরস্ক। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং আইনশৃঙ্খলাজনিত নানা সমস্যা থাকার কারণে আঙ্কারার সামনে এখনও খোলেনি সেই দরজা। এ ব্যাপারে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেন বলেছেন, ‘‘মেয়রের গ্রেফতার খুবই উদ্বেগজনক। তুরস্ককে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে আরও বেশি করে ভাবতে হবে।’’

২১ ২১

এর্ডোগানের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে খুবই নৈকট্য রেখে চলেছে আঙ্কারা। কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুরস্কের ভারত-বিরোধিতার সুর ছিল খুবই চড়া। গণবিক্ষোভে তিনি কুর্সি হারালে সেই নীতি থেকে সরে আসতে পারে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। আবার পশ্চিমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কুর্সি বাঁচাতে রাশিয়ার হাত ধরতে পারেন বর্ষীয়ান এর্ডোগান। পূর্ব ইউরোপের জল কোন দিকে গড়ায়, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement