তাঁর মৃত্যুরহস্য নিয়ে আজও নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন, যুদ্ধে পরাজিত প্রেমিকের মৃত্যুর খবর পেয়ে রানি আত্মহত্যা করেছিলেন। আবার কারও মত, সাপের দংশনেই মৃত্যু হয়েছিল মিশরের টলেমীয় সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সক্রিয় শাসক সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার।
রোমান সাম্রাজ্যের রাজনীতি, অন্তর্দ্বন্দ্ব, আলেকজান্দ্রিয়ার স্বর্ণযুগ, সেনানায়কের সঙ্গে তাঁর প্রেম নিয়ে কথা ও কল্পনা যতটা নাটকীয়, তার চেয়েও রহস্যময় ক্লিওপেট্রার মৃত্যু। ২০৫০ বছর পরেও রানির সমাধির হদিস না মেলায় আজও সেই জটিল ধাঁধার জট ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদেরা।
তবে এক দল প্রত্নতত্ত্ববিদের দাবি, অবশেষে রোমান সেনানায়ক মার্ক অ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্রার সমাধিস্থলের হদিস মিলেছে। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তাঁরা একটি সুড়ঙ্গের সন্ধান পেয়েছেন, যার শেষ প্রান্তে নাকি শায়িত রয়েছেন ক্লিওপেট্রা ও তাঁর প্রেমিক অ্যান্টনি।
সান ডোমিংগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্যাথলিন মার্টিনেজ ও তাঁর দলবল প্রায় ২০ বছর ধরে ক্লিওপেট্রার সমাধির খোঁজ করছেন। তাঁদের দাবি, আফ্রিকার উত্তর প্রান্তে মিশরের নীল নদ যেখানে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে মিশেছে, সেখানেই ‘টাপোসিরিস ম্যাগনা’ নামে একটি প্রাচীন শহরে কৃষি ও প্রজননশক্তির দেবতা ওসাইরিসের একটি মন্দিরের তলায় সেই সুড়ঙ্গটি মিলেছে।
মার্টিনেজদের অনুসন্ধানের পর মিশরের পর্যটন ও পুরাতত্ত্ব মন্ত্রকও সম্প্রতি জানিয়েছে, সদ্য আবিষ্কৃত সুড়ঙ্গটি পাথর খুঁড়ে তৈরি। মাটির প্রায় তেতাল্লিশ ফুট গভীরে থাকা এই সুড়ঙ্গটির দৈর্ঘ্য দেড় কিলোমিটারের কাছাকাছি।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ক্লিওপেট্রার ‘রাজ্য’ আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ১৮ মাইল দূরে সেই টাপোসিরিস ম্যাগনা শহর। আলেকজান্দ্রিয়া প্রাচীন মিশরের মন্দিরের শহর ছিল। নগরী জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ওসাইরিস এবং দেবী সিরিয়াসের বেশ কিছু মন্দির। সেই রকমই একটি মন্দিরের নীচে সুড়ঙ্গটি রয়েছে।
কিন্তু টাপোসিরিস ম্যাগনা শহরের মন্দিরের নীচে সুড়ঙ্গেই যে ক্লিওপেট্রা এবং অ্যান্টনির সমাধি রয়েছে, এই সিদ্ধান্তে কী ভাবে উপনীত হলেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা? মার্টিনেজ বলছেন, তাঁরা কয়েকটি সূত্র ধরে এগিয়েছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ক্লিওপেট্রা্কে যে নামে ডাকা হত, সেটি।
মার্টিনেজের দাবি, জীবদ্দশায় ‘দেবী আইসিস’ নামে ডাকা হত ক্লিওপেট্রাকে। আর অ্যান্টনি ছিলেন ‘ওসাইরিস’। যিনি একাধারে আইসিসের স্বামী এবং ভাই। দেবদেবীদের নিয়ে প্রচলিত ‘মিথ’কে স্মরণে রেখেই অ্যান্টনিকে ওসাইরিসের মন্দিরে সমাধিস্থ করতে চেয়েছিলেন রানি।
এই সূত্র ধরে এগিয়ে সাফল্যও এসেছে। নতুন আবিষ্কৃত সুড়ঙ্গে খননকার্য চালিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সোনার টুকরো, ক্ষয়ে যাওয়া আবক্ষমূর্তি, আলেকজান্দার দ্য গ্রেট, ক্লিওপেট্রা এবং টলেমিদের প্রতিচ্ছবি-যুক্ত মুদ্রার হদিস মিলেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা একটি হ্রদেরও সন্ধান পেয়েছেন ওই মন্দিরের কাছে।
প্রায় একশো বছর আগে হদিস মিলেছিল মিশরীয় ফারাও তুতেনখামেনের সমাধির। এখনও পর্যন্ত সেই আবিষ্কারকেই মিশরের ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ঘটনা বলে মনে করা হয়। এ বার যদি মার্টিনেজের দেখানো পথে সত্যিই ক্লিওপেট্রার সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়, তবে সেটিই হবে একবিংশ শতাব্দীর ‘সবচেয়ে বড়’ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার।
‘অক্টিয়াম’ যুদ্ধে রোমান সম্রাট অক্টাভিয়াস অগাস্টাস সিজারের হাতে অ্যান্টনির পরাজয় এবং পরবর্তী কালে ক্লিওপেট্রা-অ্যান্টনির মৃত্যু নিয়ে আজও প্রচুর ধোঁয়াশা রয়েছে।
ক্লিওপেট্রার মৃত্যু নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত মত হল, খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে সর্পদংশনে রানির মৃত্যু হয়েছিল।
এই তত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল সর্প বিশেষজ্ঞ। তাঁদের জানান, ফলের ঝুড়িতে লুকনো গোখরো সাপের দংশনে রানি ও তাঁর দুই দাসীর মৃত্যু হয়েছিল বলে যে কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং অলীক।
ওই বিশেষজ্ঞদের দাবি, তিন জনকে ছোবল মারতে পারে, এত বড় গোখরো সাপের পক্ষে ওইটুকু ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে থাকা কার্যত অসম্ভব।
ম্যানচেস্টার জাদুঘরের মিশর বিষয়ক দুই বিশেষজ্ঞ জয়েস টিলডেসলি এবং অ্যান্ড্রু গ্রে বলছেন, এ ধরনের গোখরো সাপ সাধারণত ৫ থেকে ৬ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। তা ছাড়া, একই সাপের ছোবলে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হওয়াও সম্ভব নয়।
বিষাক্ত কিছু খেয়ে ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছেন, অনেকের এমন দাবিও আবার মানতে রাজি নন ক্লিওপেট্রার জীবনীকার স্ট্যাসি মেডেলিন শিফ।
২০১০ সালে জার্মান ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার শেফার আবার দাবি করেছেন, হেমলক, বিষাক্ত নীল ফুল এবং আফিমের মিশ্রণ খেয়েই ক্লিওপেট্রার মৃত্যু হয়েছিল।
প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ইতিহাদবিদদের মত, রানির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে তাঁর সমাধি খুঁজে পাওয়া ভীষণ ভাবে জরুরি।