কলকাতা পুরবোর্ডের সিদ্ধান্তে শহর থেকে পাকাপাকি ভাবে বিদায় নিতে চলেছে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ। তৃণমূল সরকারের সূচনা পর্বে এই আলো যেমন বর্ণময় করেছিল রাজধানী কলকাতাকে, তেমনই গোড়া থেকে এর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল বিতর্ক।
পুরসভা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, কলকাতায় নতুন করে আর কোনও ত্রিফলা আলো লাগানো হবে না। যেখানে যেখানে এই বাতিস্তম্ভ রয়েছে, ধীরে ধীরে বিদায় নেবে সেগুলিও। প্রশ্ন উঠছে, ত্রিফলা চলে গেলে শহরের সেই সব রাস্তায় এ বার আলো জোগাবে কে? পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন থেকে বসানো হবে অত্যাধুনিক একফলা বাতিস্তম্ভ।
চলতি বছরের বর্ষায় চার মাসের জন্য ত্রিফলা বাতিস্তম্ভগুলিকে বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুরসভা। বর্ষা শেষে সেগুলি আবার জ্বালানো হয়। তবে কয়েক মাস যেতে না যেতেই সেগুলিকে পাকাপাকি ভাবে সরানোর কথা জানিয়ে দিয়েছে পুরপ্রশাসন।
খরচ অনেক বেশি। অথচ কম টেকসই। মূলত, এই দুই কারণে এক দশকের মধ্যেই বাতিলের খাতায় নাম তুলতে চলেছে ত্রিফলা। কলকাতা পুরসভার আলোক বিভাগ জানিয়েছে, এখনও সচল থাকা ত্রিফলা বাতিস্তম্ভগুলি কোনও কারণে ভেঙে গেলে, সেখানে আর নতুন ত্রিফলা লাগানো হবে না। বসানো হবে একফলা বাতিস্তম্ভই। পুরসভা সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই পাঁচশোর বেশি ভাঙা, আধভাঙা বা অকেজো ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ সরিয়ে, একফলা বাতিস্তম্ভ বসিয়ে ফেলা হয়েছে।
একফলা বাতিস্তম্ভ লাগানোর ফলে রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিদ্যুতের খরচ অনেকটাই কমে যাবে বলে দাবি আলোক বিভাগের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের। সম্প্রতি কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের নির্দেশে পুর কমিশনার বিনোদ কুমার ত্রিফলা বাতিস্তম্ভের একটি অডিট রিপোর্টও তৈরি করেন। তাতেই বাতিস্তম্ভগুলির নানাবিধ সমস্যার কথা উঠে এসেছে।
সেই অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে, শহরের কোথাও কোথাও একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে বহু বাতিস্তম্ভ। বাতি থাকা সত্ত্বেও বহু রাস্তায় ত্রিফলাগুলি অকেজো অবস্থায় পড়ে।
পুরসভার রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে শহরের প্রায় তিন হাজার ত্রিফলা অকেজো। কোনও কোনও ত্রিফলাতে একটি বাতি টিমটিম করে জ্বললেও কোনও কোনওটিতে তিনটি বাতিই কাজ করে না। সবই সরিয়ে ফেলা হবে।
২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরই কলকাতার সৌন্দর্যায়নে জোর দেয় কলকাতা পুরসভা। সেই সৌন্দর্যায়নের অন্যতম প্রতীক হয়ে ওঠে ত্রিফলা। ধীরে ধীরে ত্রিফলা সদ্য ক্ষমতায় আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বপ্ন প্রকল্প’তে পরিণত হয়।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কলকাতাকে ঢেলে সাজাতে শহর জুড়ে লাগানো হবে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ। যা শহরকে আলো এবং সুরক্ষা যেমন দেবে, তেমনি দেবে সৌন্দর্যও।
২০১২ সালে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ত্রিফলা বাতি লাগানোর কাজ শুরু হয়। সারা শহরে সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার ত্রিফলা আলো লাগানো হয়েছিল। খরচ হয়েছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকা।
প্রথম ত্রিফলা বাতিস্তম্ভটি লাগানো হয়েছিল কালীঘাটে। কালীঘাটের হরিশ মুখার্জি রোডে প্রথম বসানো হয় এই তিন মাথার বাতিস্তম্ভ।
কলকাতার রাস্তায় ‘জন্ম’ নিতে না নিতেই একাধিক বিতর্ক ধাওয়া করতে শুরু করে ত্রিফলাকে।
তৎকালীন পুরবোর্ডের একাংশের বিরুদ্ধে ত্রিফলার টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে, পুরবোর্ডের তরফে বাজারদরের থেকে অনেক বেশি দামে এই ত্রিফলা কেনা হয়েছিল।
ত্রিফলা নিয়ে অনিয়ম ধরা পড়ে পুরসভার বিভাগীয় অডিটেও। গরমিল প্রকাশ্যে আসতেই তড়িঘড়ি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় পুরসভার তৎকালীন ডিজি (আলো)-কে। শুরু হয় বিভাগীয় তদন্ত।
পরে তদন্তের ভার যায় ‘কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’ (সিএজি)-এর কাছে। তদন্ত শেষে সিএজি রিপোর্টে জানায়, বাজারদরের চেয়ে বেশি টাকায় কিনে ত্রিফলার জন্য বাড়তি অনেক টাকা খরচ করেছে পুরসভা। সেই অঙ্ক প্রায় আট কোটি। যদিও এই দুর্নীতির কোনও প্রমাণ পরবর্তী কালে সামনে আসেনি।
আর একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিদ্যুতের বিল। পুর নথি অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাতিস্তম্ভের জন্য পুরসভার বিদ্যুতের বিল ছিল প্রায় ২ কোটি টাকা। দু’বছর গড়িয়ে ২০১৪ সালে তা এক ধাক্কায় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ কোটিতে। অনেকটা বাড়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচও।
এ সবের মধ্যে শহর জুড়ে চলতে থাকে ত্রিফলার বাতি চুরির ঘটনা! শুধু বাতিই নয়, চুরি করা হচ্ছিল বাতিস্তম্ভের অন্যান্য অংশও। নথি অনুযায়ী, রাস্তায় লাগানোর পর পরই চুরি গিয়েছিল হাজার খানেক বাতি।
ত্রিফলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর অভিযোগও ওঠে পরবর্তী সময়ে। বিশেষত বর্যাকালে। সেই কারণেই চলতি বছরে বর্ষাকালের চার মাস ত্রিফলাগুলি বন্ধ ছিল।
এ বছর মার্চে, অর্থাৎ বর্যার আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কলকাতায় আর নতুন করে কোনও ত্রিফলা বসানো হবে না। অগস্টে আরও এক ধাপ এগিয়ে আস্তে আস্তে সব ত্রিফলাই সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় পুরসভা।