অতিমারিতে চাকরি হারিয়ে দু’বছর বসে থাকার পর আচমকাই এসেছিল ভাল চাকরির প্রস্তাব। দুবাইয়ে ইন্টারভিউ। কর্মক্ষেত্র তাইল্যান্ড। বেতন এতটাই ভাল যে, কোয়েম্বত্তুরের বাসিন্দা, পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার স্টিফেন ওয়েসলি হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন। তবে স্টিফেন ভাবতে পারেননি সেই ‘ভাল বেতনের’ বিনিময়ে কর্মক্ষেত্রে কী অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য!
নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে রওনা হয়েছিলেন কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই চেপে বসতে শুরু করে ভয়। স্টিফেন জানিয়েছেন, ভয়ের কারণ ছিল মূলত দু’টো। এক, যে ভাবে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। দুই, কর্মক্ষেত্রে পৌঁছনোর আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাঁদের পাসপোর্ট। জোর করে সই করানো হয়েছিল চুক্তিপত্রে। অথচ এ ব্যাপারে আগে থেকে একটি কথাও জানানো হয়নি তাঁদের।
অবশ্য তখন আর বেরিয়ে আসার উপায় নেই। গোলকধাঁধার ভিতরে পা ফেলা হয়ে গিয়েছে। স্টিফেনরা তখনও জানেন না আগামী ৯৬ দিন সেই গোলকধাঁধার অলিগলিতে ঠোক্কর খেতে হবে তাঁদের। হবে নরকদর্শন।
গত ৫ অক্টোবর স্টিফেন-সহ ৪৫ জন ভারতীয়কে উদ্ধার করা হয়েছে তাইল্যান্ড থেকে। মুক্তি পেয়ে ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’কে দেওয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন স্টিফেন। তবে বলতে বলতে বার বার গলা কেঁপে গিয়েছে তাঁর।
স্টিফেনের কথায়, ‘‘অফিস বলতে একটি ছোট ঘর। তবে সেখানে ঢোকার আগে সশস্ত্র রক্ষীদের সামনে ঝাড়া ১৫ মিনিট হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে বসতে হয়েছিল। সেই সময়েই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল চাকরি আসলে কিসের? ঠিক কী কাজ করতে হবে আমাদের।’’
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল বিষয়টা। স্টিফেনরা বুঝতে পারছিলেন, যে সংস্থায় তাঁরা যোগ দিয়েছেন, তা আসলে ক্রিপ্টোকারেন্সির জালিয়াতির কাজ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ধনী ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়।
কী ভাবে? স্টিফেনের কথা অনুযায়ী, ধনী ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে মডেলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করিয়ে দেওয়ার টোপ দেওয়া হত। সেই টোপ সহজেই গিলতেনও তাঁরা।
এই ব্যবসায়ীদের কী ভাবে চিহ্নিত করা হত? স্টিফেন জানিয়েছেন, যে সমস্ত ব্যবসায়ী ডেটিং অ্যাপে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতেন, তাঁরাই শিকার হতেন এই সংস্থার।
স্টিফেনদের কাজ ছিল বিভিন্ন মডেলের নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করা। ব্যবসায়ীদের যাতে কোনও রকম সন্দেহ না হয়, তার জন্য বহু মহিলাকেও কাজে নিয়োগ করত সংস্থাটি। তারাই ওই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলত।
মডেলদের সঙ্গে সম্পর্কের টোপ দিয়ে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ করতে রাজি করাতেও হত। সেই সব বিনিয়োগের ভিত্তিতে প্রথম প্রথম ভাল রিটার্নও পেতেন ব্যবসায়ীরা। তবে তারও নিয়ম ছিল।
১০০-২০০ ডলার বিনিয়োগ করলে তার রিটার্ন দেওয়া হত ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কোনও গ্রাহক যদি ১০ হাজার ডলারের বেশি বিনিয়োগ করতেন, তবে তাঁর পুরো টাকাটাই নিয়ে তাঁকে ব্লক করে দিত সংস্থাটি।
স্টিফেনদের মতো কর্মীদের কাজ ছিল প্রতিদিন এমন অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। এটাই ছিল প্রতিদিনের কাজের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য পূরণ না করলেই জুটত কড়া শাস্তি।
বন্দুকধারীদের পাহারার মধ্যেই চলত কাজ। শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বও ছিল তাঁদেরই। যে সমস্ত কর্মী লক্ষ্যপূরণ করতে পারতেন না বা কাজ করতে চাইতেন না, তাঁদেরই দেওয়া হত শাস্তি।
রক্ষীদের সঙ্গে থাকত বিদ্যুতের ব্যাটন। অবাধ্য কর্মীদের শাস্তি দেওয়া হত সেই ব্যাটনের বৈদ্যুতিক শক দিয়ে। মানসিক অত্যাচারের পাশাপাশি নিরন্তর চলত শারীরিক নিগ্রহ।
স্টিফেন জানিয়েছেন, তাঁদের মতো জনা ১৬ ভারতীয় কাজ করতেন ওই অফিসে। গত ১৫ অগস্ট তাঁদের উদ্ধার করে মায়ানমার সেনা। কিন্তু তার পরও তাঁদের দুর্ভোগ শেষ হয়নি।
উদ্ধার করার পর তাঁদের নিজেদের সদর দফতরে রাখে সেনাবাহিনী। তার পর তাঁদের নিভৃতবাসে রাখা হয়। ১৬ জন ভারতীয়ের পাসপোর্ট এবং মোবাইল ফোন উদ্ধার করে আনে সেনাবাহিনী। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এর পর স্টিফেনদের কাছের বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার রাস্তা বলে দিয়ে ছেড়ে দেয় সেনারা।
স্টিফেন জানিয়েছেন, যাওয়ার সময় ব্যাঙ্কক থেকে দু’টি ট্যাক্সিতে তুলে আনা হয়েছিল তাঁদের। পরে পথে একটি জঙ্গলের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে আবার দু’টি ট্রাকে করে জঙ্গলের রাস্তাতে তাঁরা পৌঁছন একটি নদীর ধারে। নৌকোয় করে সেই নদী পেরিয়েই তাঁরা পৌঁছেছিলেন ওই কর্মক্ষেত্রে। ফেরার সময় সে ভাবেই এগোতে থাকেন তাঁরা। কিন্তু ওই জঙ্গলের রাস্তাতেই তাঁদের গ্রেফতার করে পুলিশ। আবার কেড়ে নেওয়া হয় তাঁদের পাসপোর্ট-মোবাইল।
১৫ দিন পুলিশের হেফাজতে থাকতে হয়। তার পর আদালতে তোলা হয় তাঁদের। হয় জরিমানা। আরও ১৬ দিনের হেফাজতও।
স্টিফেন জানিয়েছেন, সেই দিনগুলিতে প্রতি মুহূর্তে অপরাধীদের মতো আচরণ করা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে। অথচ কোনও দোষই ছিল না কারও। শেষে ভারতীয় দূতাবাসের হস্তক্ষেপে ৯৬ দিন পর দেশে ফেরেন স্টিফেনরা। তবে ৯৬ দিনের ওই দুঃস্বপ্ন এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁদের।