প্রথমে রেললাইনে বিস্ফোরণ। তার পর দু’পারের পাহাড় থেকে নেমে এসে আস্ত্রেয়াস্ত্র হাতে যাত্রীবোঝাই ট্রেনে উঠে পড়া। এ ভাবেই পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেসকে অপহরণ করেন স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘বালোচ লিবারেশন আর্মি’ (বিএলএ)। দক্ষিণ-পশ্চিম পাক ভূখণ্ড বালোচিস্তানের এই ঘটনায় শিউরে উঠেছে গোটা দুনিয়া। ট্রেন ছিনতাইয়ের এই ঘটনাকে ইতিমধ্যেই বিরলতম বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
তথ্য বলছে, গত ১০০ বছরে যাত্রীবোঝাই ট্রেন অপহরণ হয়েছে আর মাত্র এক বার। সে বার ঘটনাস্থল ছিল চিন। শুধু তা-ই নয়, পণবন্দি যাত্রীদের উদ্ধার করতে রীতিমতো কালঘাম ছুটে যায় বেজিঙের। এর জন্য সময় লেগেছিল পাক্কা এক মাস সাত দিন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, শতবর্ষ পর একই রকমের ঘটনা ঘটল ড্রাগনের ‘অভিন্নহৃদয় বন্ধু’ পাকিস্তানে। যদিও পণবন্দি উদ্ধারে বেশি সময় নেয়নি ইসলামাবাদ।
সালটা ছিল ১৯২৩, তারিখ ৬ মে। ওই দিন ভোরে অভিনব পদ্ধতিতে বিলাসবহুল পিকিং এক্সপ্রেসকে ছিনতাই করে একদল চিনা ডাকাত। তাদের হাতে পণবন্দি হন ৩০০ জন যাত্রী। যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন বিদেশি। ড্রাগন-ডাকাতেরা ৩৭ দিন বন্দি রাখেন তাঁদের। যাত্রীদের সঙ্গে থাকা মূল্যবান সামগ্রী লুট করা হয়। ইতিহাসে এই ঘটনার উল্লেখ আছে ‘লিনচেং আতঙ্ক’ হিসাবে।
চিনা ডাকাতদের হাতে ছিনতাই হওয়া ট্রেনটি সাংহাই থেকে রাজধানী পিকিং (অধুনা বেজিং) যাচ্ছিল। রাস্তায় হুবেই প্রদেশের লিনচেং কাউন্টিতে চালক রেললাইনের কাছে কয়েক জন সন্দেহভাজনকে লুকিয়ে থাকতে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেন তিনি। এর পরই বিপদে পড়ে যাত্রীবোঝাই ওই ট্রেন।
ডাকাতের দল আগে থেকেই রেললাইনের একাংশ ভেঙে রেখেছিল। সেখানে পৌঁছতেই পিকিং এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়। সঙ্গে সঙ্গে দুষ্কৃতীদল হাতিয়ার নিয়ে উঠে পড়ে ট্রেনের কামরায়। তাদের মূল লক্ষ্য অবশ্য ছিলেন প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীরা, কারণ সেখানেই বহুমূল্য সামগ্রী এবং মোটা অর্থ ছিনতাইয়ের সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি।
তৎকালীন সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দাঁড়িয়ে পড়া ট্রেনে উঠে এতটুকু সময় নষ্ট করেনি চিনা ডাকাতের দল। দ্রুত যাত্রীদের থেকে যতটা সম্ভব টাকাপয়সা, গয়নাগাটি এবং মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয় তারা। ওই দিন পিকিং এক্সপ্রেসে ছিলেন সাংহাইয়ের আফিম মামলায় যুক্ত এক ইটালীয় আইনজীবী। এ ছাড়াও সফরকারীদের তালিকায় গাড়ি ব্যবসায়ী এক ধনকুবের রোমানিয়ান বংশোদ্ভূত এবং মার্কিন ব্যবসায়ী জন ডি রকফেলার জুনিয়রের শ্যালিকার নাম পাওয়া গিয়েছিল।
চিনা ডাকাতদের লুটতরাজের সময়ে গুলিবিদ্ধ হন এক রহস্যময় ব্রিটিশ-রোমানিয়ান যাত্রী। তাঁর অতীত বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল বলে পরবর্তী কালে জানা গিয়েছিল। দুষ্কৃতীরা অবশ্য ওই মৃতদেহ ডিঙিয়ে কামরায় মধ্যে চলাচল করেনি। নিহত ব্যক্তির নগদ অর্থের ব্যাগ এবং গোলাবারুদের চামড়ার থলিটির কোনও খোঁজ মেলেনি বলে রিপোর্ট করা হয়।
ট্রেনের মধ্যে ২৮ জন বিদেশি ছিলেন রাতের পোশাকে। পিকিং এক্সপ্রেস থেকে নামিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মধ্যে দিয়ে তাঁদের হেঁটে যেতে বাধ্য করে ডাকাতের দল। দুষ্কৃতীদের ওই তাণ্ডবের পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে জেমস জ়িমারম্যানের লেখা ‘দ্য পিকিং এক্সপ্রেস’ বইয়ে।
জ়িমারম্যানের দাবি, ট্রেনটিকে ছিনতাই করার জন্য ডাকাতেরা অন্তত এক মাস ধরে পরিকল্পনা করেছিল। বার বার রেকি করে লাইনের কোন অংশটিকে ভাঙা হবে, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ঘটনার দিন সেখানে ট্রেনটি পৌঁছতেই মারাত্মক ঝাঁকুনি দিয়ে পিছলে যায় ইঞ্জিন। এর পর গাড়ির চাকা আর গড়ায়নি।
বিশ শতকে এই ঘটনা ঘটার সময়ে একেবারেই ঐক্যবদ্ধ ছিল না চিন। ফলে আইনের শাসনের বদলে ড্রাগনভূমিতে চলছিল একরকমের জঙ্গলের রাজত্ব। বিদেশি নাগরিকেরা তখন নানা রকমের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। দেশ জুড়ে চলছিল চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর তার সুযোগ নিতে ছাড়েনি দুষ্কৃতীদের দল।
১৯১৬ সালে হঠাৎই মৃত্যু হয় হান সেনাপতি তথা চিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউয়ান শিকাইয়ের। এর পর ড্রাগনভূমিতে বিশৃঙ্খলা একরকম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। বেজিঙে ক্ষমতার কেন্দ্রে তখন একদল যুদ্ধবাজ। তাঁরাই আবার চিনা সরকারের বৈধতার জন্য লড়াইয়ে জড়িয়েছিলেন।
পরবর্তী প্রেসিডেন্ট লি ইউয়ানহং বেজিঙের অবস্থা ভাল করতে পারেননি। উল্টে তাঁর আমলে আরও কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায় দেশ। ওই সময়ে কোনও সুস্পষ্ট নীতি মেনে চলছিল না চিনা কর ব্যবস্থা। ফলে সরকারে থাকা যুদ্ধবাজেরা লম্বা সময় ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে গ্রামগুলিকে নিশানা করতে থাকেন। সেখানে প্রায়ই লুটতরাজ চালাতেন তাঁরা।
বেজিঙের যুদ্ধবাজদের হাত থেকে নিরীহ নাগরিকদের রক্ষা করতে স্বায়ত্তশাসনে থাকা শানডং প্রদেশের সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট তৈরি করেছিল। পরবর্তী কালে জানা যায়, লিনচেং ট্রেন ছিনতাইকাণ্ডের মূল চাঁইরা ছিল ওই ফৌজের অংশ। পিকিং এক্সপ্রেসের যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের গোপন ডেরায় নিয়ে যায় তারা। মোটা টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে যাত্রীদের ছেড়েছিল ওই ডাকাতদল।
পণবন্দি রেলযাত্রীদের মধ্যে মাত্র ২৫ জন ছিলেন চিনা নাগরিক। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে তাঁদের জীবিত ছেড়ে দিতে মোট ১৫ লক্ষ ডলার মুক্তিপণ নিয়েছিল চিনা দুষ্কৃতীরা। তবে লুট করা মূল্যবান সামগ্রী, অর্থ বা অলঙ্কারের কিছুই ফেরত দেয়নি তারা।
ইতিহাসবিদ ফিল বিলিংসলি তাঁর লেখা ‘ব্যান্ডিট্স ইন রিপাবলিকান চায়না’ বইয়ে ডাকাতদলের এক জনের বক্তব্য প্রকাশ করেন। ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ডাকাত হওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই। কিন্তু অস্থির অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ। সরকার বলে যে বস্তুটি রয়েছে, তা আমাদের নিরাপত্তা বা জীবনধারণের প্রতিশ্রুতি দিতে ব্যর্থ। এই অবস্থায় ঝুঁকি না নিলে মৃত্যু ছাড়া অন্য রাস্তা খোলা নেই।’’
লিনচেঙের ট্রেন ছিনতাইয়ের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ার পর চিন জুড়ে বিদেশিদের উপর ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ওই সময়ে সুযোগ পেলেই ট্রেনে চলত দেদার ভাঙচুর। ফলে অচিরেই বিদেশিরা বুঝে যান, বেজিং তাঁদের রক্ষা করতে অপারগ। এর জেরে ধীরে ধীরে ড্রাগনভূমি ছাড়তে শুরু করেন তাঁরা।
এ দিকে ডাকাতদলের হাত থেকে পণবন্দিদের উদ্ধার করার পরের দিনই গদিচ্যুত হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লি ইউয়ানহং। পরবর্তী চার বছরে ওই কুর্সিতে বসেন অন্তত ন’জন। কেউই অবশ্য ড্রাগনভূমিতে শান্তি ফেরাতে পারেননি। তাই ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, বিশ শতকে চিনের পতনের অন্যতম কারণ ছিল পিকিং এক্সপ্রেস অপহরণ।
বিলিংসলি লিখেছেন, ‘‘ট্রেনগুলিকে রক্ষা করতে চিনা সরকার যে কোনও পদক্ষেপই করেনি, এমনটা নয়। স্টেশন চত্বর এবং রেললাইনে বাড়ানো হয় পুলিশি টহল। বিলাসবহুল গাড়ির কামরায় মোতায়েন থাকত সশস্ত্র বাহিনী। আর পরও লিনচেঙের ক্ষত কোনও দিনই মুছতে পারেনি বেজিং।’’