এ যেন গোদের উপর বিষফোড়া! এমনিতেই শেয়ার বাজার নিম্নমুখী থাকায় মোটা লোকসান হয়েছে লগ্নিকারীদের। তার মধ্যে আবার ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্কের স্টকে নামল ধস। বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম কমতে কমতে ৬৭৫ থেকে ৬৮০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এর প্রভাব অন্যান্য ব্যাঙ্ক এবং মিউচুয়াল ফান্ডের উপর পড়ার রয়েছে প্রভূত আশঙ্কা। ফলে চিন্তায় রাতের ঘুম উড়েছে বিনিয়োগকারীদের।
চলতি বছরের ১১ মার্চ ২৭ শতাংশ নিম্নমুখী হয় ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্কের স্টকের দর। ফলে ৫২ সপ্তাহের সর্বনিম্ন স্তরে চলে আসে হিন্দুজ়া গোষ্ঠীর এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। ওই তারিখে ইন্ডাসইন্ডের এক একটি স্টকের দাম দাঁড়ায় ৬৫৯.৫৫ টাকা। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসের পর আর্থিক সংস্থাটির এটি সবচেয়ে বড় পতন বলে জানা গিয়েছে।
ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্কের শেয়ারের দাম এ ভাবে হু-হু করে পড়ে যাওয়ার নেপথ্যে মূলত এর ডেরিভেটিভ্স অ্যাকাউন্টের অসঙ্গতিকেই দায়ী করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। ব্যাঙ্কের তরফে সেই তথ্য প্রকাশ করার পরেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন লগ্নিকারীরা। দ্রুত স্টক বিক্রি করতে থাকেন তাঁরা। ফলে নিম্নমুখী হয়েছে শেয়ারের সূচক।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে ইন্ডাসইন্ডের ডেরিভেটিভ্স পোর্টফোলিয়োতে অসঙ্গতির বিষয়টি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআইয়ের নজরে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুজা গোষ্ঠীর আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। পাশাপাশি গলদ খুঁজতে ডেরিভেটিভ্স পোর্টফোলিয়োর অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার নির্দেশ দেয় আরবিআই।
সূত্রের খবর, অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় জানা গিয়েছে, ইন্ডাসইন্ড কর্তৃপক্ষ অতীতে ফরেক্স (বিদেশি মুদ্রা) লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত হেজ খরচের অবমূল্যায়ন করেছে। ফলে ব্যাঙ্কের রাজস্বের উপর তার প্রভাব দেখা গিয়েছে। আর্থিক সংস্থাটির মোট লোকসানের পরিমাণ ১,৬০০ থেকে দু’হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটি কোনও বড় আকারের কেলেঙ্কারি কি না, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই ডেরিভেটিভ্স পোর্টফোলিয়ো? কোনও লগ্নিকারীর (ব্যক্তি হোক বা প্রতিষ্ঠান) একগুচ্ছ বিনিয়োগের সমাহারকে আর্থিক পরিভাষায় বলা হয় ডেরিভেটিভ্স পোর্টফোলিয়ো। এর মধ্যে একাধিক আর্থিক চুক্তি, বন্ড, স্টক বা সোনায় লগ্নি থাকতে পারে। মূলত ঝুঁকি কমানো বা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের জন্য ডেরিভেটিভ্স পোর্টফোলিয়ো তৈরি করেন বিনিয়োগকারীরা।
ব্রোকারেজ সংস্থাগুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ২.৫ শতাংশ রাজস্ব হারায় ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্ক। ফলে অনেকটাই হ্রাস পায় লাভের অঙ্ক। ডেরিভেটিভ্স পোর্টফোলিয়োর অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে যে পরিমাণ আর্থিক অসঙ্গতির প্রমাণ মিলেছে, ডিসেম্বরের লোকসান প্রায় তার সমান বলে মনে করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হল, গত এক বছরে ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্কের শেয়ারের দাম কমেছে ৪২ শতাংশ। এ বছরের জানুয়ারিতে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির স্টকের দর ১,৬৭৪ টাকা ছুঁয়েছিল। এটাই ছিল এর সর্বোচ্চ দাম। সেখানে ১১ মার্চ, এক দিনে এর শেয়ারে ২০ শতাংশের পতন দেখতে পাওয়া গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, শেয়ারে বাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি একে অপরের স্টক প্রভূত পরিমাণে কিনে থাকে। কারণ ব্যাঙ্কের শেয়ারের দরের বড় রকমের অস্থিরতা প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। ফলে ইন্ডাসইন্ডের স্টকের পতনের প্রভাব সামগ্রিক ভাবে দেশীয় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার উপর কতটা পড়বে, ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন।
ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্কের শেয়ারের দর নামায় সবচেয়ে বড় লোকসান দেখা গিয়েছে মিউচুয়াল ফান্ডে। রাতারাতি ওই তহবিলগুলি থেকে উবে গিয়েছে ছ’হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এইচডিএফসি মিউচুয়াল ফান্ড ৩,৫৬৪ কোটি এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) মিউচুয়াল ফান্ড ৩,০৪৮ কোটি টাকা হারিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৫টি মিউচুয়াল ফান্ডের হাতে থাকা মোট শেয়ারের পরিমাণ ছিল ২০.৮৮ কোটি, যার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২০,৬৭০ কোটি টাকা। ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্কের শেয়ারের পতনের পর সেটাই ১৪,৬০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। মিউচুয়াল ফান্ডের বড় লগ্নিকারীদের মধ্যে আইসিআইসিআই প্রুডেনশিয়ালের লোকসান হয়েছে ৩,৭৭৯ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে একই রকমের পরিস্থিতির শিকার হয় ইয়েস ব্যাঙ্ক। ওই বছর ৩৯৩ টাকা থেকে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দর মাত্র ১০ টাকায় নেমে আসে। হিন্দুজা গোষ্ঠীর আর্থিক সংস্থাটির পরিণতিও এ রকম হতে পারে বলে লগ্নিকারীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। যদিও সেই আশঙ্কা কম বলেই মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাঙ্ক হল ইন্ডাসইন্ড। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের চিফ এগ্জ়িকিউটিভ অফিসারের (সিইও) মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধি করার দাবি তোলে হিন্দুজা গ্রুপ। কিন্তু, তাতে সম্মতি দেয়নি আরবিআই। সিইওর কাজের মেয়াদ মাত্র এক বছর বাড়াতে পারবেন ইন্ডাসইন্ড কর্তৃপক্ষ।
আরবিআইয়ের এই সিদ্ধান্তের পর সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কটির শেয়ারের দামে সামান্য ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গিয়েছে। তবে তার পরও অন্যান্য ব্যাঙ্কের স্টকে এর প্রভাব ঠেকানো যায়নি। গত ১১ মার্চ নিফটি ব্যাঙ্ক সূচক ০.৭ শতাংশ এবং নিফটি ৫০-এর সূচকে ০.২৭ শতাংশের পতন দেখা গিয়েছে।
পরিস্থিতি সামলাতে বিস্তারিত ভাবে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা শুরু করেছেন ইন্ডাসইন্ড কর্তৃপক্ষ। একটি বহিরাগত সংস্থাকে এর জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। মোট লোকসানের পরিমাণ চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৪-’২৫) চতুর্থ ত্রৈমাসিকের শেষে, অর্থাৎ ৩১ মার্চের পর বা আগামী আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষে, অর্থাৎ জুনে প্রকাশ করবে হিন্দুজা গোষ্ঠীর এই সংস্থা।
বর্তমান অবস্থায় এমকে গ্লোবাল বা নুভামার মতো ব্রোকারেজ সংস্থাগুলি ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্কের শেয়ারকে ইতিমধ্যেই ‘কেনার শ্রেণি’ (বাই ক্যাটেগরি) থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এর সম্ভাব্য দাম ২২ শতাংশ হ্রাস করেছেন তারা। ৭৫০ থেকে ৮৭৫ টাকার মধ্যে ইন্ডাসইন্ডের স্টকের দর ঘোরাফেরা করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে শেয়ারটির দাম ৯২৫ টাকা পর্যন্ত উঠবে বলে দাবি করেছে মতিলাল ওসওয়াল নামের ব্রোকারেজ ফার্ম।
বিশ্লেষকদের দাবি, নিজেদের গলদ খুঁজে বার করার ক্ষেত্রে ইন্ডাসইন্ড কর্তৃপক্ষ তৎপর হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা ২০১৯ সালের ইয়েস ব্যাঙ্কের মতো হওয়ার আশঙ্কা কম। ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ব্রিটেনবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দুজা পরিবার। তাঁদের দাবি, ইন্ডাসইন্ডের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট মজবুত। আর তাই লগ্নিকারী বা গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
ফলে আপাতত অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বিনিয়োগকারী এবং গ্রাহকেরা। সেখানে কোনও আর্থিক কেলেঙ্কারি ধরা না পড়লে এ যাত্রা ফাঁড়া কাটাতে পারবেন ইন্ডাসইন্ড কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য, শেয়ার বাজারে লগ্নি বাজারগত ঝুঁকিসাপেক্ষ। আর তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনেই স্টকে বিনিয়োগ করুন। এতে আর্থিক ভাবে লোকসান হলে আনন্দবাজার ডট কম কর্তৃপক্ষ কোনও ভাবেই দায়ী নয়।