নব্বইয়ের দশকের বাণিজ্যিক বাংলা ছবির অন্যতম জনপ্রিয় মুখ। দুই দশক টলিপাড়ায় থাকার পর সোজা রাজনীতির মাঠে। ২০০৯ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ তিনি। প্রথম বার নির্বাচনে লড়াই করেই জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসাবেও যে সফল হবেন, তা নিয়ে তেমন আশাবাদী ছিলেন না শতাব্দী রায়।
বীরভূমে তিন বারের সাংসদ শতাব্দী। এ বার চতুর্থ বার লোকসভা ভোটে লড়াই করছেন তিনি। ভোটপ্রচারের শেষ দিন পর্যন্তও ‘ঝড়’ তুলেছিলেন তিনি। প্রচারে বেরোলেই নাকি বার বার বিক্ষোভের মুখে পড়েন শতাব্দী। গ্রামবাসীরা তাঁর কাছে নানা রকম অভিযোগ জানান। কখনও তিনি আশ্বাস দেন, কখনও বা মেজাজ হারিয়ে তাঁর মুখে শোনা যায় ‘‘ইডিয়ট! ইডিয়ট!’’
তারকা অভিনেত্রী শতাব্দীকে রাজনীতি অনেক কিছুই শিখিয়েছে। তবে এ বার বীরভূমে অন্য রূপ, অনুব্রতহীন। গত বার লোকসভা নির্বাচনে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল উপস্থিত এবং সক্রিয় ছিলেন। এ বার তিনি জেলবন্দি। তবুও তিহাড়ের কারাগারের ও পার থেকেই অনুব্রত যেন তাঁর উপস্থিতি টের পাইয়ে যাচ্ছেন।
বীরভূমে ভোটের ময়দানে অনুব্রত রয়েছেন বহাল তবিয়তে। সভাপতির তিহাড়বাস নিয়ে তৃণমূল নতুন স্লোগান তুলেছে। বীরভূমের দেওয়ালে শতাব্দীর সমর্থনে দেওয়ালে লেখা হয়েছে, ‘তিহাড়ে বসেই খেলা হবে’ স্লোগান।
স্লোগান লেখা হলেও অনুব্রতের অনুপস্থিতিতে কি সত্যিই ভাল ‘খেলতে’ পারবেন শতাব্দী? এই প্রসঙ্গে যদিও তারকা অভিনেত্রী জানিয়েছিলেন অনুব্রতকে মিস্ করছেন তিনি। শতাব্দীর কথায়, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলের হাতে তৈরি সংগঠন আমার হয়ে কাজ করেছে। আজ তিনি অনুপস্থিত। কিন্তু তাঁর গড়ে দেওয়া সংগঠনের লোকজন এখনও পাশে রয়েছেন। এমন এক জন ব্যক্তিত্বকে ভোটের আগে না পাওয়া গেলে তাঁকে মিস্ করা তো স্বাভাবিক! কিন্তু তাতে জয়ের ব্যবধানে পার্থক্য হবে বলে মনে হয় না। বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে চতুর্থ বারের জন্য জয়ের বিষয়ে আমি ২০০ শতাংশ আশাবাদী।’’
শতাব্দীর সঙ্গে অনুব্রতের ‘অম্লমধুর’ সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে শতাব্দীর তৃণমূল ত্যাগের জল্পনা ছড়িয়েছিল। কারণ হিসাবে তখন তৃণমূলের একাংশের ব্যাখ্যায় নাম ছিল অনুব্রতের। তবে কেষ্টর গ্রেফতারির পর তাঁর পাশেই দাঁড়ান বীরভূমের সাংসদ। গরু পাচার মামলায় বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতির নামে সিবিআইয়ের চার্জশিটে সাক্ষী হিসাবে নাম ছিল শতাব্দীর।
২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে আচমকাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বীরভূম লোকসভা আসনের প্রার্থী হিসাবে অভিনেত্রী শতাব্দীর নাম ঘোষণা করেছিলেন। তার আগে রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না তাঁর। বাংলা ছবির নায়িকাদের মধ্যে শতাব্দীই অন্যতম পরিচিত মুখ, যিনি নির্বাচনী রাজনীতির লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটে অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়কে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ভোটের ময়দানে নামিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু সে যাত্রায় পরাজিত হয়েই নিজের রাজনীতির ইনিংসে ইতি টানেন মাধবী। সে দিক থেকে দেখতে হলে অবশ্যই ব্যতিক্রমী শতাব্দী।
প্রথম বার ভোটে লড়াই করেই জিতেছিলেন টলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী শতাব্দী। প্রথম বার তাঁর লড়াই ছিল বীরভূমের প্রবীণ সিপিএম নেতা ব্রজ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হয়েই রাজনীতিক শতাব্দীর পথচলা শুরু হয়। ২০০৯ সালে তিনি যে ব্যবধানে জিতেছিলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে তা আরও বৃদ্ধি পায় তেমনই ২০১৯ সালে দেশ জুড়ে মোদী-হাওয়াও টাল খাওয়াতে পারেনি সেই ব্যবধানে। বরং তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য সেই শতাব্দীতেই ভরসা রেখেছে তৃণমূল।
২০২৩ সালে ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচিতে ‘দিদির দূত’ হিসাবে কাজ করেছিলেন শতাব্দী। সেই কর্মসূচি উপলক্ষে বেরিয়ে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। বিষ্ণুপুর এলাকার তেঁতুলিয়ায় এক দলীয় কর্মীর বাড়িতে গিয়ে নাকি খাবার না খেয়ে উঠে যান তিনি। সেই ছবি, ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়তেই বিতর্ক দানা বাঁধতে থাকে। অভিযোগ ছিল, খাবারের সামনে বসে না খেয়ে নাকি শুধু ছবি তুলেছেন তিনি। তবে তৃণমূল সাংসদের কথায়, তিনি খেয়েছিলেন। কিন্তু খাওয়ার পর খাবারের সঙ্গে তাঁর ছবি তোলার অনুরোধ করেছিলেন সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকেরা। তাই হাত ধুয়ে আসার পর ছবি তুলবেন বলে পাতের সামনে বসেছিলেন। শতাব্দীর দাবি, তাঁর ওই ছবিটিই ‘এডিট’ করে অপপ্রচার করা হয়েছিল।
নীলবাড়ি দখলের লড়াই যখন তুঙ্গে, সেই সময় সারদা চিটফান্ড-কাণ্ডে বড় পদক্ষেপ করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। অভিনেত্রী সাংসদ শতাব্দীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সারদা গোষ্ঠীতে কর্মরত ছিলেন শতাব্দী। ২০১২ সালে অভিনেতা এবং রাজনীতিবিদ মিঠুন চক্রবর্তী সারদার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের পদ ছেড়ে দেওয়ার পরেই শতাব্দীকে সেই পদে নিযুক্ত করা হয়।
২০১৫ সালেও সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের অভিনেত্রী-সাংসদ শতাব্দী রায়কে সমন পাঠিয়েছিল ইডি। শতাব্দীর সঙ্গে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের প্রায় ১ কোটি টাকার একটি লেনদেন হয়েছিল বলে জানতে পেরেছিলেন ইডি-র গোয়েন্দারা।
ইডি-র পাশাপাশি শতাব্দীকে ২০১৬ সালে নোটিস পাঠিয়েছিল সিবিআই। এমনকি একাধিক বার বীরভূমের সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিলেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। শতাব্দীর সঙ্গে কত টাকার চুক্তি হয়েছিল, সে বিষয়ে জানতে চেয়ে ২০১৯ সালে তাঁকে আবার নোটিস পাঠানো হয়। জানা গিয়েছে, কুরিয়ারের মাধ্যমে ইডি দফতরে ৩১ লক্ষ টাকার ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট পৌঁছে দিয়েছিলেন শতাব্দী।
রাজনীতিতে নামার পর রুপোলি পর্দা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন শতাব্দী। অথচ অভিনয়ের সঙ্গে যে তাঁর সুতো ছিঁড়ে গিয়েছিল, এমনটা নয়। সিনেমা থেকে সরে গেলেও নাটকের সঙ্গে নিজেকে জুড়েছিলেন অভিনেত্রী। এমনকি, যাত্রার মঞ্চেও তাঁকে দেখা গিয়েছে।
১৯৬৯ সালের ৫ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের আগরপাড়ায় জন্ম শতাব্দীর। কলকাতায় স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। ১৯৮৬ সালে ‘আতঙ্ক’ ছবির মাধ্যমে টলি অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বড় পর্দায় জুটি বেঁধে অভিনয়জগতে আত্মপ্রকাশ শতাব্দীর।
টলি অভিনেতা তাপস পালের সঙ্গে শতাব্দীর জুটি ছিল জনপ্রিয়। ‘অমর বন্ধন’, ‘আপন আমার আপন’, ‘অন্তরঙ্গ’ এবং ‘আবিষ্কার’-এর মতো একাধিক বাংলা ছবিতে তাপসের বিপরীতে অভিনয় করতে দেখা যায় শতাব্দীকে। ১৯৮৭ সালে অঞ্জন চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গুরুদক্ষিণা’ মুক্তি পাওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি অভিনেত্রীকে। কেরিয়ারের ঝুলিতে একের পর এক হিট ছবি ভরতে থাকেন তিনি। ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবিতেও শতাব্দীর নায়ক ছিলেন তাপস।
লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শতাব্দী। তাঁর লেখা একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘শতাব্দীর আড্ডায়’ নামে একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওম শান্তি’ নামের একটি বাংলা ছবির পরিচালনা করেন শতাব্দী। এই ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় তাপস পাল এবং ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে। অভিনয়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খোলেন তারকা-অভিনেত্রী।
বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা যায় শতাব্দীকে। নব্বইয়ের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নয়া জ়হর’, ‘মুলাকাত’, ‘লভ স্টোরি ৯৮’ এবং ‘দ্য জঙ্গিপুর ট্রায়াল’ নামের হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। তা ছাড়া ওড়িয়া ছবিতেও অভিনয় করেন শতাব্দী। ‘ন্যায় অধিকার’, ‘ছন্নছাড়া’, ‘পরশমণি’, ‘আমার শপথ’, ‘মঙ্গলদীপ’, ‘মর্যাদা’, ‘শত্রুপক্ষ’, ‘আলিঙ্গন’, ‘অনুরাগ’, ‘লাল পান বিবি’র মতো ছবি রয়েছে শতাব্দীর কেরিয়ারে। ২০০১ সালে মৃগাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় শতাব্দীর। বিয়ের পর পুত্রসন্তান সাম্যরাজের (তোজো) জন্ম দেন অভিনেত্রী। তার পর শতাব্দী দত্তক নেন কন্যা শামিয়ানাকে (জ়ুমি)। বর্তমানে শতাব্দীর নজর শুধু নির্বাচনের লড়াইয়ে। তিন বারের সাংসদ কেষ্টহীন বীরভূমে জিততে পারেন কি না, তা অবশ্য সময়ই বলবে।