মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে বিতর্ক যেন থামতেই চাইছে না। সূচনাপর্বের প্রথম দিনেই এই বিলকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া বিতর্ক এবং উত্তেজনার সাক্ষী হল নতুন সংসদ ভবন। মঙ্গলবার নতুন সংসদ ভবনে বসেছিল বিশেষ অধিবেশন। সেই অধিবেশনে এই বিল পেশ করাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায় সাংসদের দুই কক্ষে। এই বিল পাশ করার কৃতিত্ব কার, তা নিয়ে বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, লোকসভা মুলতুবি হয়ে যায়।
লোকসভার পাশাপাশি মহিলা সংরক্ষণ বিল ঘিরে মঙ্গলবার বিতর্ক ছড়ায় রাজ্যসভাতেও। কংগ্রেস সভাপতি তথা রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গের মন্তব্যের প্রতিবাদে সরব হতে দেখা গেল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে।
লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় এক তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করতে মঙ্গলবার পুরোদস্তুর নতুন বিল এনেছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। যার পোশাকি নাম, ‘নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম’ বিল। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল ১২৮তম সংবিধান সংশোধনী বিল হিসাবে তা লোকসভায় পেশ করেন।
সেখানে লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী মহিলা সংরক্ষণ বিলের ‘ইতিহাস’ তুলে ধরেন। অধীরের দাবি, কংগ্রেস আমলে বিলটি আনা হয়েছিল। উদ্যোগী হয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। যার প্রতিবাদ জানান শাসকদলের সাংসদেরা। অধীরের পর বক্তব্য শুরু করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অধীর অসত্য তথ্য দিচ্ছেন বলে দাবি করেন শাহ।
শাহ বলেন, ‘‘সেই সরকারের আর অস্তিত্ব নেই। বিলটির মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছে।’’ শাহের দাবি, রাজ্যসভায় কোনও বিল পাশের পর যদি সংশ্লিষ্ট লোকসভার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তবে বিলটির কার্যকারিতা বহাল থাকে না।
লোকসভায় অধীরের মতো রাজ্যসভায় একই রকমের দাবি তোলেন খড়্গে। সাংসদের উচ্চ কক্ষে বক্তৃতা করার সময় মহিলা বিল পেশের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘‘২০১০ সালে মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন মহিলা সংরক্ষণ বিল সংসদের এই কক্ষে পাশ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরা (মোদী সরকার) আমাদের কৃতিত্ব দিতে চায় না।’’
শাসক বা বিরোধী যা-ই দাবি করুক না কেন, মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে ইতিহাস কী বলছে?
সংসদের ইতিহাস বলছে, প্রবল রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আটকে রয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল।
সূত্রপাত ১৯৮৯ সালে। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সরকার পঞ্চায়েত এবং পুরসভা নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করার প্রস্তাব দিয়ে বিল আনে। সেই বিল লোকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় পাশ হয়নি।
১৯৯৩ সালে নরসিংহ রাওয়ের সরকার সেই বিল পাশ করিয়ে আইন করে।
এর পর ১৯৯৬ সালে লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব দিয়ে প্রথম বার মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করে দেবগৌড়া সরকার।
১৯৯৬ সালেই সেই বিল ‘প্রাইভেট মেম্বারস বিল’ হিসাবে সিপিআই সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে যায়। ডিসেম্বরে এই বিল নিয়ে রিপোর্ট পেশ করে যৌথ কমিটি। তবে লোকসভা ভেঙে যাওয়ার কারণে বিলটি অচল হয়ে যায়।
এর পর অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় কেন্দ্র। ১৯৯৮ সালে প্রথম বাজপেয়ী সরকার লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করলেও তা পাশ হয়নি।
১৯৯৯, ২০০২ এবং ২০০৩ সালেও বিল পাশের চেষ্টা করে বাজপেয়ী সরকার। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।
সে সময় সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, জেডিইউ-এর মতো দল মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত এক তৃতীয়াংশ আসনের মধ্যেই আলাদা ভাবে তফসিলি জাতি-জনজাতি এবং ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণ চালুর দাবি জানায়। রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবেই মূলত বিলটি সংসদে পেশ করা যায়নি।
২০০৮ সালে ইউপিএ জমানায় নতুন করে বিল সংসদে পেশ করা হয়। রাজ্যসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার। সেই বিল সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাত ঘুরে দু’বছর পর রাজ্যসভায় পাশ হয়। কিন্তু লোকসভায় সরকারের সমর্থক এবং বিরোধীদের একাংশের আপত্তির জেরে সেই বিল পাশ হয়নি।
ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধীর উদ্যোগে ২০১০ সালে বিলটি রাজ্যসভায় পাশের সময়েও সংসদের উচ্চকক্ষ রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল।
এর পর এক দশকেরও পর মঙ্গলবার লোকসভায় ফের মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করল কেন্দ্রের মোদী সরকার। বিলের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এই বার অধিকাংশ দলই সেই বিল ‘সমর্থন’ করেছে।
কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা বিলটিকে ‘সমর্থন’ করলেও তা কার্যকর হওয়ার সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মঙ্গলবার পেশ করা বিলে বলা হয়েছে আসন পুর্নবিন্যাসের পর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী, আসন পুর্নবিন্যাসের আগে জনগণনা হবে।
শেষ জনগণনা হয়েছিল ২০১১ সালে। ২০২১ সালে তা হওয়ার কথা থাকলেও করোনা আবহে তা বিলম্বিত হয়। চলতি বছরে কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের শেষে জনগণনা হবে। অর্থাৎ, প্রক্রিয়া শুরু হতেই ২০২৪-এর শেষ। যা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হতে ২০২৬-এর শেষ বা ২০২৭ সালের প্রথম দিক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সে ক্ষেত্রে বিল ২০২৯ সালের আগে কার্যকরের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই ধারণা সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশের। বিরোধী নেতারা অবশ্য কেন্দ্রের এই বিলকে ‘সরকারের নির্বাচনী চমক’ বা ‘জুমলা’ বলে দাবি করেছেন।
তবে সূত্রের খবর, শাসক এবং বিরোধী শিবিরের অনেক দলের পাশাপাশি, বিজেপির মধ্যেও এই বিল নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। কারণ, ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হলে পরের ভোটে অনেক পুরুষকেই প্রার্থীপদ খোয়াতে হবে।