লক্ষদ্বীপ। ভারতের ক্ষুদ্রতম কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হয়েছে ৩৬টি আলাদা আলাদা দ্বীপ নিয়ে। মোট আয়তন ৩২ বর্গ কিলোমিটার।
এত দিন সেই জায়গা সম্বন্ধে সকলের কমবেশি জানা থাকলেও, বছরে খুব কম ভারতীয়েরই পা পড়ত সেখানে।
মালয়ালম এবং সংস্কৃতে লক্ষদ্বীপ কথার অর্থ লক্ষ দ্বীপের সমন্বয়। এই দ্বীপপুঞ্জ পশ্চিমে আরব সাগর এবং পূর্বে লক্ষদ্বীপ সাগরের মধ্যে সামুদ্রিক সীমানা হিসেবে কাজ করে।
ভারতের মালাবার উপকূল থেকে প্রায় ৪৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সেই দ্বীপপুঞ্জেই এখন নজর দেশবাসীর। কারণ, ভারত-মলদ্বীপ নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক।
ঝিকিমিকি লেগুন, সাদা বালির সৈকত এবং প্রচুর প্রবাল— লক্ষদ্বীপ এবং মলদ্বীপের মধ্যে মিল প্রচুর। কিন্তু তবুও বিলাসবহুল ভ্রমণের উদ্দেশে ভারতীয়দের বেশি ভিড় জমে মলদ্বীপে। ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রায় আড়াই-তিন লক্ষ ভারতীয় মলদ্বীপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই রীতিই পাল্টাতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মলদ্বীপের বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে চলেছে কেন্দ্রশাসিত লক্ষদ্বীপ।
লক্ষদ্বীপের পুরনো সৈকতগুলি সাদা বালি এবং স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জলের জন্য বিখ্যাত।
লক্ষদ্বীপ পর্যটন বিভাগের সরকারি ওয়েবসাইট অনুযায়ী, দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। তবেই সেখানে যাওয়ার অনুমতি মেলে।
লক্ষদ্বীপের দ্বীপগুলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বহু আদিবাসী উপজাতিদের বাস। তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার কথা মাথায় রেখেই সব দ্বীপে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না।
লক্ষদ্বীপে প্রবেশের অনুমতিপত্রের ফর্ম অনলাইনে পাওয়া যায়। সেই ফর্ম জমা দিতে হয় প্রশাসনের কাছে। সেই ফর্ম খতিয়ে দেখে প্রবেশের জন্য সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়।
লক্ষদ্বীপে প্রবেশের অনুমতি পাঠানো হয় ইমেল মারফত। কোন পর্যটক ক’দিন দ্বীপপুঞ্জে কাটাবেন এবং তিনি কোন দেশের বাসিন্দা, তার উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্যও নেওয়া হয়।
প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার পরেই হোটেল এবং বিমানের টিকিট বুক করতে পারেন পর্যটকেরা। লক্ষদ্বীপে সাধারণত ৩০ দিনের বেশি থাকার অনুমতি দেওয়া হয় না।
লক্ষদ্বীপ ৩৬টি দ্বীপের সমন্বয়ে তৈরি হলেও এর মধ্যে কাভারত্তি, আগত্তি, বাঙ্গারাম, কদমত এবং মিনিকয়—এই পাঁচটি দ্বীপেই ভ্রমণ করার অনুমতি রয়েছে পর্যটকদের।
এর মধ্যে জলক্রীড়াপ্রেমীদের পর্যটকদের পছন্দের জায়গা আগত্তি দ্বীপ। বিভিন্ন ধরনের জলক্রীড়ার আয়োজন রয়েছে সেই দ্বীপে।
মিনিকয় আবার ঐতিহ্যবাহী নৃত্য—‘লাভা’র জন্য বিখ্যাত। উৎসব-অনুষ্ঠানে সেই নৃত্য পরিবেশিত হয়।
মিনিকয়ে ‘জাহাধনি’ নামে বিভিন্ন রঙিন নৌকার একটি প্রতিযোগিতা হয়। যা পর্যটকের কাছে বিশেষ আকর্ষণের। মিনিকয় দ্বীপ টুনা মাছের জন্যও বিখ্যাত। ঔপনিবেশিক ভারতে ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশরা লক্ষদ্বীপে একটি টুনা মাছ প্রক্রিয়াকরণের কারখানা তৈরি করেছিল।
কদমত দ্বীপ পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে। আবার কাভারত্তি পরিচিত ঝলমলে বাজারহাটের কারণে।
বাঙ্গারাম পর্যটক টানে প্রবালপ্রাচীর এবং বিভিন্ন ধরনের মাছের সম্ভারের কারণে।
লক্ষদ্বীপের অধিকাংশ মানুষ মালায়লম ভাষায় কথা বলেন। মিনিকয় দ্বীপে কথা বলা হয় মাহি বা মাহল ভাষায়, যার সঙ্গে পুরনো সিংহলী ভাষার মিল রয়েছে। তবে কেউ কেউ হিন্দিতেও কথা বলেন।
লক্ষদ্বীপের জনসংখ্যার সিংহভাগই থাকে আন্দ্রোট, কাভারত্তি, মিনিকয় এবং আমিনি দ্বীপে।
লক্ষদ্বীপে গেলে যে পদ খেতেই হবে, তা হল মুস কাবাব। সুগন্ধি চালের উপর টুনা মাছ, সবজি এবং মশলার স্তর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। পরে মুখবন্ধ পাত্রে রান্না করা হয়। এ ছাড়াও বিরিয়ানি, কদালাক্কা এবং টুনা কারি সেখানকার জনপ্রিয় খাবার। লক্ষদ্বীপের দ্বীপগুলি বিভিন্ন অচেনা ফলেরও ভান্ডার।
তবে সুরাপ্রেমীদের জন্য লক্ষদ্বীপ সঠিক গন্তব্য নয়। যদিও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মদ পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয়। তবে লক্ষদ্বীপের কয়েকটি মাত্র এলাকায় মদ পাওয়া যায়। শুধুমাত্র কাভারত্তি এবং বাঙ্গারাম দ্বীপের কয়েকটি জায়গায় মদ বিক্রি হয়।
স্থানীয়দের জন্য আবার মদ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র পর্যটক এবং সরকারি কর্মচারীদের মদ বিক্রি করা হয়।
লক্ষদ্বীপের সমুদ্রে নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটা বা সৈকতে নগ্ন হয়ে সূর্যস্নান (সানবাথ) করা নিষিদ্ধ। এমনকি, লক্ষদ্বীপে কেউ যদি অনুমতি ছাড়া গাছ থেকে নারকেল পাড়েন, তা হলেও তিনি শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।
সম্প্রতি লক্ষদ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লক্ষদ্বীপের সমুদ্রে প্রধানমন্ত্রী মোদীর স্নর্কেলিং (এক ধরনের জলক্রীড়া) করা, সাদা বালির উপর ভ্রমণ বা বিশাল নীল সৈকতে বিশ্রাম নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার দিনই ৫০ হাজার মানুষ লক্ষদ্বীপ নিয়ে গুগ্লে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। ফলে মনে করা হচ্ছে চলতি বছর থেকে ভিড় আরও বাড়বে লক্ষদ্বীপের সমুদ্রসৈকতে।
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্য করায় বিগত কয়েক দিনে যে ঝড় বয়ে গিয়েছে, তার জেরে রোষের মুখে পড়েছে মলদ্বীপ সরকার।
এর পরেই সমাজমাধ্যম জুড়ে ‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর হিড়িক উঠেছে। মলদ্বীপকে বয়কট করার ডাক দিয়েছেন বলিউড ও ক্রিকেট মহলের নক্ষত্রেরাও। পাশাপাশি তাঁরা উৎসাহ জোগাচ্ছেন লক্ষদ্বীপের মতো ভারতীয় দ্বীপগুলি ঘুরে দেখার।
ভারত-মলদ্বীপ নিয়ে বিতর্কের মাঝে দেশবাসীর চোখ এখন লক্ষদ্বীপের দিকে। ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা চলছে ভারতীয় কেন্দ্রশাসিত দ্বীপপুঞ্জকে ঢেলে সাজানোর। হোটেল, ওয়াটার রিসর্ট থেকে বিমানবন্দর! দ্রুত পাল্টানোর পরিকল্পনা চলছে মলদ্বীপের ‘বিকল্প’ লক্ষদ্বীপের চেহারা।