পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে প্রায়ই বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে গ্রিস আর তুরস্ক। সমুদ্রের সীমান্ত নিয়ে সামরিক তৎপরতা দেখা গিয়েছে দুই দেশের মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
গ্রিসের দাবি, কোস, সামোস, লেসবস-সহ পূর্ব এজিয়ান সাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে তুরস্ক। ওই দ্বীপগুলির উপর দিয়ে নাকি নিয়মিত যুদ্ধবিমানও ওড়াচ্ছে তারা।
১৯২৩ সালে লুসানের চুক্তি অনুযায়ী, গ্রিস আর তুরস্কের বর্তমান সীমান্ত নির্ধারিত হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী লেসবস, চিওস, সামোসের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পেয়েছিল গ্রিস।
১৯৪৭ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, গ্রিস বা তুরস্ক একে অপরের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনও দ্বীপ বা দ্বীপপুঞ্জে সেনা মোতায়েন করতে পারবে না৷ কিন্তু তুরস্কের অভিযোগ, তুরস্কের পশ্চিম উপকূলে সেনা মোতায়েন করেছে গ্রিস৷
এজিয়ান সাগরকে কেন্দ্র করে গ্রিস-তুরস্ক উত্তেজনার মূলে রয়েছে একাধিক বিষয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাদেশীয় সমুদ্রসীমার সীমাবদ্ধতা, দ্বীপগুলির নিরস্ত্রীকরণ এবং আকাশসীমা৷ সমুদ্রসীমাকে কেন্দ্র করে বিরোধের কথা স্বীকার করেছে গ্রিসও৷
ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে খনিজ তেল নিয়ে এর আগেও বিবাদে জড়িয়েছে গ্রিস-তুরস্ক৷ এই সব বিষয়ে একমত না হওয়ায় বছর তিনেক আগে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিটসোটাকিসের সঙ্গে বৈঠক করতে অস্বীকার করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোগান। শুধু তাই নয়, পরোক্ষে নাকি যুদ্ধের হুমকিও দেন এর্ডোগান৷
এর্ডোগানের হুঁশিয়ারিতে গ্রিক বিদেশমন্ত্রী দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনে জানান, প্রতিবেশীর প্রতি অসম্মানজনক বিবৃতি এবং অনৈতিক কার্যকলাপ করে না গ্রিস, ভবিষ্যতেও করবে না।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লেসবস দ্বীপে তুরস্কের একটি পণ্যবাহী জাহাজকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে গ্রিসের নৌসেনার বিরুদ্ধে৷ গ্রিসের দাবি, জাহাজের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। জাহাজটি পরিদর্শনের দাবি জানালে তুরস্কের নাবিক অস্বীকার করেন৷ এজিয়ান সাগরের এই অঞ্চল আন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই জলপথ দিয়েই তুরস্ক থেকে ইউরোপে যাতায়াত করা হয়৷
অন্য দিকে তুরস্কের অভিযোগ, গ্রিস আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে। রাশিয়ার নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৩০০ দ্বারা তুর্কি বিমানকে বাধা দিচ্ছে গ্রিস৷ এই দাবি অস্বীকার করে গ্রিস। তুর্কি বিমান চলাচলে বাধা দিলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে, সতর্ক করেছেন এর্ডোগান৷
আঙ্কারা-আথেন্স দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে তুরস্ককে প্রতিবেশীসুলভ আচরণের দাবি জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ সামরিক জোট নেটোর মহাসচিব জেনস স্টেলটেনবার্গ গ্রিস আর তুরস্ককে পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
এই পরিস্থিতিতে গ্রিস-তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা কতটা? এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তুরস্ক আর লিবিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বা ‘এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জ়োন’ (ইইজ়েড)-এর৷ ইইজ়েড সমুদ্রের একটি এলাকা, সাধারণত একটি দেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমার বাইরে ২০০ নটিক্যাল মাইল, অর্থাৎ ৩৭০ কিলোমিটারের কিছু বেশি পরিমাণ এলাকায় বিস্তৃত৷ যার মধ্যে একটি উপকূলীয় দেশের সব ধরনের সম্পদভোগের অধিকার রয়েছে।
তুরস্ক আর লিবিয়ার মধ্যে যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে সেখানে গ্রিসের একটি দ্বীপ অবস্থিত৷ ২০১৯-এর নভেম্বরে তুরস্ক আর লিবিয়ার মধ্যে সামুদ্রিক চুক্তি হয়৷ এই চুক্তি অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগরের প্রাকৃতিক সম্পদ তুরস্কের দক্ষিণ উপকূল আর লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূল অঞ্চল মিলিত ভাবে ব্যবহার করতে পারে৷
ভূমধ্যসাগরের এই অঞ্চল বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তির ফলে এই অঞ্চলে তাদের সার্বভৌমত্ব খর্ব হচ্ছে বলে মনে করছে গ্রিস।
কিন্তু কেন এই চুক্তি করল লিবিয়া আর তুরস্ক? নেটোর তালিকাভুক্ত গ্রিস আর তুরস্কের সমুদ্রসীমায় রয়েছে বহু দ্বীপ৷ ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অফ দ্য সি (ইউএনসিওএলএস) হল একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি৷ এটি পরিবেশ আর সমুদ্রের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করে এবং পাশাপাশি অবস্থিত দেশগুলির মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে৷ এই চুক্তি মানলে দ্বীপসংলগ্ন এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ গ্রিসের সঙ্গে মিলিত ভাবে ব্যবহারের অনুমতি থাকত তুরস্কের৷
লিবিয়া-তুরস্ক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করলেও তুরস্ক ইউএনসিওএলএস চুক্তিতে স্বাক্ষর না করায় গ্রিস সমুদ্রসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কোনও পদক্ষেপ করতে পারছে না।
উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন বা নেটো ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি সামরিক সহযোগিতার জোট। এই জোটের শর্ত, নেটো জোটভুক্ত দেশগুলি একে অপরকে সামরিক সহযোগিতা প্রদান করবে। গ্রিস-তুরস্ক নেটোর তালিকাভুক্ত।
নেটোর তালিকায় থাকা দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলে যে দেশ প্রথম যুদ্ধের পদক্ষেপ করবে, সেই দেশ নেটোর তালিকা থেকে বাতিল হয়ে যাবে। ফলত অন্য দেশটিকে নেটোর বাকি দেশগুলি রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে৷ এই শর্তের কারণে উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও গ্রিস-তুরস্ক সরাসরি যুদ্ধঘোষণা করেনি এখনও পর্যন্ত।
তবে সমুদ্রসীমার যে অংশকে কেন্দ্র করে গ্রিস-তুরস্ক বিবাদ, সেই অঞ্চল বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পথ৷ গ্রিস আর তুরস্ক যুদ্ধ করলে তার প্রভাব পড়বে বিশ্ববাণিজ্য এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে৷
যদিও ২০২২ এবং ২০২৩ সালে তুরস্কে ভূমিকম্পের কারণে যখন বিপর্যয় হয়েছিল, তখন তুরস্ককে সহযোগিতা করেছিল গ্রিস৷ অন্য দিকে রেল দুর্ঘটনায় গ্রিসের দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তুরস্ক।
গ্রিস আর তুরস্ক দুই দেশের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব রাখে ভারত৷ তবে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারতের অর্থনীতি এবং বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
চলতি বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী মিটসোটাকিস। বৈঠকের পরে মোদী জানিয়েছিলেন, উভয় দেশেরই প্রধান লক্ষ্য হল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এ ছাড়াও উভয় পক্ষের সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।