তিনি সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া ‘অভাগা’। তবে তাঁর যাওয়া-আসার পথে সাগরের জল শুকোয় না। পরমাণু বিস্ফোরণ হয়!
নাম সুতোমু ইয়ামাগুচি। জাপানের সুতোমু হিরোশিমার পরমাণু বিস্ফোরণের সময় হিরোশিমায় ছিলেন। আবার তার ঠিক তিন দিন পর যখন নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলা হল, তখন সেখানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি।
অদ্ভুত ভাবে প্রতি বারই বিস্ফোরণস্থল থেকে তাঁর দূরত্ব ছিল তিন কিলোমিটারের। ফলে বিস্ফোরণের তীব্রতায় গুরুতর জখম হন। সাময়িক অন্ধ হয়ে যান, শ্রবণশক্তিও হারিয়ে যায় তাঁর। তার পরও বেঁচে যান।
পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সুতোমু জাপানের সংস্থা মিৎসুবিশির জন্য তেলবাহী জাহাজের নকশা করতেন। ১৯৪৫ সালের ৬ অগস্ট কাজের সূত্রেই তিনি ছিলেন হিরোশিমায়। তিন মাসের কেজো সফর সেরে সে দিনই তাঁর বাড়ি ফেরার কথা ছিল হিরোশিমা থেকে।
সাতসকালে দুই সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে হিরোশিমা স্টেশনের দিকে রওনাও হয়ে গিয়েছিলেন সুতোমু। কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হয় তাঁকে।
জাপানে যে কোনও সরকারি পরিষেবার জন্য জরুরি যে পরিচয়পত্র তার নাম হ্যাংকো। সুতোমুর হঠাৎই খেয়াল হয় তিনি হিরোসিমায় তাঁর গত তিন মাসের অফিসে নিজের হ্যাংকোটি ফেলে এসেছেন। সহকর্মীদের স্টেশনে যেতে বলে আবার অফিসের দিকে রওনা হন সুতোমু।
ঠিক সকাল সওয়া ৮টায় সুতোমু যখন অফিসের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে গিয়েছেন, নিশ্চিন্তে হাঁটছেন বন্দরের পাশ দিয়ে, তখনই ঘটে ঘটনাটি।
আমেরিকার বোমারু বিমান ‘এনোলা গে’ হিরোশিমা শহরের ঠিক মাঝখানে নিক্ষেপ করে পরমাণু বোমা ‘লিটল বয়’।
পরে নিজের বইয়ে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণায় সুতোমু লেখেন, তিনি বোমারু বিমানটিকে আকাশে দেখেছিলেন। ঠিক তখনই দু’টি প্যারাশ্যুটকেও নামতে দেখেন। সুতোমুর কথায়, ‘তার পরই আকাশে একটা প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি, আর আমি ছিটকে গেলাম।’
হিরোশিমার ওই বিস্ফোরণে কানের পর্দা ফেটে গিয়েছিল সুতোমুর। কিছু ক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
বিস্ফোরণস্থলের কাছে থাকায় রাসায়নিক বিকিরণে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনেকটাই ঝলসে যায় জাহাজ নকশাকারের। জ্ঞানও হারান তিনি।
জ্ঞান ফিরলে প্রথমেই দুই সহকর্মীর খোঁজ করেন সুতোমু। খুঁজে না পেয়ে জখম শরীরেই উঠে বসেন বাড়ি ফেরার ট্রেনে। পরমাণু বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হিরোশিমায় অদ্ভুত ভাবে তখনও ট্রেন পরিষেবা চালু ছিল!
সুতোমুর বাড়ি নাগাসাকিতে। হিরোশিমার দুর্ঘটনার পরের দিনই ৭ অগস্ট নিজের শহর নাগাসাকি পৌঁছন তিনি। মারাত্মক জখম হওয়া সত্ত্বেও গোটা গায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ৯ অগস্ট হাজির হন কাজে।
তাঁকে দেখে অবাক হয়ে যান তাঁর অফিসের সহকর্মীরা। ঊর্ধ্বতন কর্তাকে হিরোশিমার ঘটনার বিবরণ দিতে যাওয়ায় তিনি সুতোমুকে ‘পাগল’ বলে ঠাট্টাও করেন। ঠিক তখন, ৯ অগস্ট সকাল ১১টায় পরমাণু বিস্ফোরণ হয় নাগাসাকিতে।
সুতোমুর অফিস থেকে ঠিক তিন কিলোমিটার দূরে ফেলা হয় আমেরিকার পরমাণু বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’। এ বারও বেঁচে যান সুতোমু।
তবে শারীরিক আঘাত না পেলেও নাগাসাকির বিস্ফোরণের পর টানা এক সপ্তাহ ধূম জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন সুতোমু। টানা বমিও হতে থাকে তাঁর।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর ১৯৫০ সালে অনুবাদক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন সুতোমু। পরে পুরনো অফিস মিৎসুবিশিতেও ফিরে আসেন। আগের মতোই আবার জাহাজের নকশা করার কাজ শুরু করেন। স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেন।
নাগাসাকি বিস্ফোরণের সময় সুতোমুর স্ত্রীও ছিলেন শহরেই। তিনিও বেঁচে যান। দু’জনে এর পর দুই কন্যা সন্তানের জন্মও দেন। পরে নিজের বইয়ে সুতোমু লিখেছিলেন, সেই সময় নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা একরকম ভুলতে চাইছিলেন তিনি। বিষয়টি যে অতীত এটুকু ভেবেই নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে তাঁর একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হতে শুরু করে।
তখনও সরকারি খাতায় তিনি শুধু নাগাসাকির বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ। তাঁর হিরোসিমার অভিজ্ঞতার কথা তখনও জানেই না সরকার। অথচ সুতোমুর সন্তানেরা সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং শারীরিক ক্ষতির ভার বয়ে নিয়ে চলেছে নিজেদের শরীরে।
বয়স যখন প্রায় আশির কোঠায় তখন সুতোমু ঠিক করেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখবেন। পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতার ‘আঁখো দেখা হাল’ জানাবেন দেশের মানুষকে। সুতোমুর সেই বই অবাক করে দেয় জাপানের মানুষকে।
২০০৬ সালে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় তথ্যচিত্র। ছবিটির প্রদর্শন হয়েছিল আমেরিকাতেও। সেখানে শক্তিশালী দেশগুলির উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছিলেন দু’বার পরমাণু বোমাকে ধোঁকা দেওয়া সুতোমু। বলেছিলেন, ‘‘আপনারা দয়া করে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করুন। অস্ত্র তৈরি করা বন্ধ করুন।’’
২০০৯ সালে হলিউডের পরিচালক জেমস ক্যামেরন দেখা করেন তাঁর সঙ্গে। তাঁকে নিয়ে ছবি বানানোর কথাও বলেন। তবে তত দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সুতোমু।
বিকিরণের তীব্র প্রভাব পড়েছিল তাঁর শরীরে। শেষ বয়সে ছানি, লিউকোমিয়ার মতো অসুখে পড়েন। ২০০৯ সালে সুতোমু জানতে পারেন তিনি পাকস্থলীর ক্যানসারেও আক্রান্ত। তত দিনে ক্যানসারে স্ত্রীকে হারিয়েছেন তিনি।
ঠিক এই সময়েই সুতোমুর মনে হয় তাঁর জোড়া পরমাণু বোমা অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি থাকা দরকার। তাঁর নিজের জন্য নয়, ভবিষ্যতে পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানসে সচেতনতা তৈরি করতেই ওই স্বীকৃতি দরকার। সরকারের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আবেদন করেন। আর স্বীকৃতি পেয়েও যান। তিনিই একমাত্র, যাঁর দু’টি বিস্ফোরণেরই সাক্ষী হওয়ার কথা মেনে নিয়েছে জাপানের সরকার।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে মারা যান সুতোমু। ওই বছরই ডিসেম্বরে তাঁকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করে বিবিসি। অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য আনলাকিয়েস্ট ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। অনুষ্ঠানটিতে সুতোমুর ঘটনাটিকে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে উপস্থাপন করার জন্য সমালোচিত হয়েছিল বিবিসি। শেষে প্রকাশ্যে ক্ষমাও চাইতে হয় তাঁদের।
তবে বিবিসির অনুষ্ঠান প্রয়াত সুতোমুকে একটি নতুন নামও দেয়— ‘দ্য আনলাকিয়েস্ট ম্যান’। বাংলা অর্থ অভাগা। যা সুতোমুর জীবদ্দশাতেই স্বীকার করে নিয়েছিল খোদ জাপানের সরকারও।