নারায়ণ সান্যালের ‘প্রবঞ্চক’-এর কাহিনি মনে পড়ে? কী ভাবে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্ববিখ্যাত মোনালিসা চুরি যায়, এবং কী ভাবে তা উদ্ধার হয়, তার রোমহর্ষক বর্ণনা রয়েছে সেই উপন্যাসে। দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার মতোই বিখ্যাত শিল্পসৃষ্টি ‘দ্য স্ক্রিম’। এডওয়ার্ড মুনখ এঁকেছিলেন এই ছবি। এই ছবি নিয়েও রহস্য নেহাত কম নেই। রহস্য এর বিষয় বা শৈলী নিয়ে নয়। রহস্য, এই শিল্পকর্ম চুরি যাওয়া নিয়ে। এক বার নয়, দু’বার চুরি গিয়েছিল ছবিটি।
১৯৯৪ সালে নরওয়েতে বসেছিল শীতকালীন অলিম্পিকের আসর। ১২ ফেব্রুয়ারি অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল। সেই দিনই অসলোর ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে চুরি যায় ‘দ্য স্ক্রিম’ ছবিটি।
১৮৯৩ সালে ছবিটি এঁকেছিলেন মুনখ। কার্ডবোর্ডের উপর তেলরং, প্যাস্টেল এবং টেম্পুরা দিয়ে। বিষয় ছিল ‘প্যানিক অ্যাটাক’। আধুনিক যাপনের ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছিল ছবিতে।
১৯৯৪ সালে অলিম্পিকের কারণে এমনিতেই ভিড় ছিল অসলো শহরে। যাদুঘরেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যেই দু’জন চুরি করেছিলেন ছবিটি।
অলিম্পিকের কারণে ন্যাশনাল গ্যালারির যে ঘরে ছবি থাকত, সেখান থেকে সরিয়ে তিন তলার এক ঘরে এনে টাঙানো হয়েছিল মুনখের সেই ছবি। চোরেরা অনায়াসে মই বেয়ে উঠে সেই ঘর থেকে চুরি করে নেয় ছবিটি। তার পর ছেড়ে যায় একটি চিরকুট। তাতে লেখা ছিল, ‘‘খারাপ নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ধন্যবাদ।’’
পরের মাসেই অভিযুক্তের ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার দাবি করে। অসলো যাদুঘর টাকা দিতে অস্বীকার করে। বদলে ব্রিটেন পুলিশের একটি শাখা, লস এঞ্জেলেসের জে পল গেটি যাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অভিযানে নামে নরওয়ে সরকার।
শেষ পর্যন্ত ছবি উদ্ধার করেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা চার্লস হিল। আমেরিকার শিল্প ব্যবসায়ী সেজে তিনি ছবিটি কিনতে গিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, আমেরিকার গেটি মিউজিয়ামের জন্য ছবিটি কিনবেন। কথার মারপ্যাঁচে দুই চোরকে বিশ্বাসও করিয়েছিলেন যে, ছবিটি সত্যিই কিনতে চান তিনি।
রাত সাড়ে ১১টায় ফোনটা এসেছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দা হিলের কাছে। দুই চোর ফোন করেন তাঁকে। জানান, ছবিটি বিক্রি করতে রাজি তাঁরা। হিল জানিয়ে দেন, শীতের রাতে ছবি কিনতে যাওয়া সম্ভব নয়। বরং কোনও এক দিন সকালে এই নিয়ে কথা বলতে চান। রাজি হয়ে যায় দুই চোর।
১৯৯৪ সালের ৭ মে ছবি সকাল বেলা ছবি কেনার দিন ঠিক হয়। চোরেদের বলা ঠিকানায় পৌঁছে যান হিল। তিনি যেতেই রান্নাঘরের কার্পেট তুলে দেন দুই চোর। তা তুলতেই চোখে পড়ে নীচে যাওয়ার সিঁড়ি। হিলস নিরাপত্তার কারণে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে অস্বীকার করেন।
এর পর এক চোর বেসমেন্টে নেমে নিয়ে আসেন সেই ছবি। মুনখের ‘দ্য স্ক্রিম’। ছবিটি পরখের জন্য খাবার টেবিলের উপর রাখা হয়। জহুরি হিলের চোখ এক নিমেষেই চিনে ফেলে। এ ছবি আসল।
হোটেলে ফিরে যান হিল। খবর দেন নরওয়ের গোয়েন্দা বিভাগকে। গোয়েন্দারা এসে পৌঁছলে তাঁদের নিয়ে পৌঁছে যান চোরেদের ডেরায়। উদ্ধার হয় ছবি।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে চার জন ছবি চুরির জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁদের মধ্যে এক জনের নাম আগেও জড়িয়েছে ছবি চুরির অপরাধে। ১৯৮৮ সালে মুনখেরই ‘ভ্যাম্পায়ার’ ছবিটি চুরি করেছিলেন তিনি।
যদিও আইনি লড়াই শেষে ছাড়া পেয়ে যান চার জনই। কারণ ওই ব্রিটিশ গোয়েন্দা অভিযানের স্বার্থেই ভুয়ো নাম পরিচয়ে নরওয়েতে প্রবেশ করেছিলেন।
২০০৪ সালে দ্বিতীয় বার অসলোর ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে চুরি যায় ‘দ্য স্ক্রিম’। সঙ্গে মুনখের আঁকা ‘ম্যাডোনা’ ছবিটিও চুরি যায়। চুরি নয়, সে বার ডাকাতি হয়েছিল। ২২ অগস্ট যাদুঘরে ঢুকে পড়েন কয়েক জন বন্দুকধারী। তাদের মুখে ছিল মুখোশ।
বন্দুক দেখিয়ে ছবিগুলি লুঠ করে পালাচ্ছিলেন অভিযুক্তেরা। ফটকের বাইরে রাখা ছিল গাড়ি। সে দিকেই যাচ্ছিলেন তাঁরা। তখনই সেখানে উপস্থিত এক জন তাঁদের ছবি তুলে নেন। পরে ১০ মাস বন্ধ ছিল অসলোর এই যাদুঘর।
তল্লাশি অভিযানে নামে পুলিশ। আকাশ পথেও চরকি পাক খেতে থাকে পুলিশের হেলিকপ্টার। এক প্রত্যক্ষদর্শী সেই গাড়ির খোঁজ দেন, যাতে ছবি চুরি করে পালিয়েছিলেন অভিযুক্তেরা।
পরের বছর এপ্রিলে একটি চুরির সূত্র ধরে এক জনকে গ্রেফতার করে নরওয়ে পুলিশ। পুলিশের মনে হয়েছিল, ছবি চুরির সঙ্গে যোগ রয়েছে তাঁর। অনেক জেরা করেও ছবি কোথায় রয়েছে, জানা যায়নি।
ক্রমেই রটতে শুরু করে যে, অভিযুক্তেরা প্রমাণ লোপাট করার জন্য ছবি পুড়িয়ে দিয়েছে। নয়তো নষ্ট করেছে। হতাশ হয়ে পড়ে নরওয়ে পুলিশ।
২০০৬ সালের শুরুতে ছ’জনকে মুনখের ছবি চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। বিচার চলে। চার জনের চার থেকে আট বছরের কারাদণ্ড হয়। তখনও মেলেনি ছবি। তবু অপরাধীরা ধরা পড়েছে বলে স্বস্তি প্রকাশ করে নরওয়ে পুলিশ।
ওই বছর অগস্টে উদ্ধার হয় ছবি দু’টি। পুরোপুরি না হলেও ক্ষতি হয়েছিল ছবি দু’টির। ‘দ্য স্ক্রিম’ ছবিটির নীচে বাঁ কোণে আর্দ্রতা জনিত ছোপ পড়ে। ‘ম্যাডোনা’ ছবিটিতে ম্যাডোনার ডান হাতে বেশ কিছু জায়গা ছেঁড়া ছিল। দু’টি ফুটোও ছিল। ছবি পুনরুদ্ধারের আগে তা সাধারণ মানুষকে দেখার ব্যবস্থা করে দেন যাদুঘর কর্তৃপক্ষ। তবে ছবিটি কী ভাবে উদ্ধার হয়েছিল, তা বিশদে কখনওই বলেনি নরওয়ে পুলিশ। পোস্ট- ছবি চুরির গল্প