‘এগজ়রসিজ়ম’ বা সাদা বাংলায় যাকে ‘ভূত তাড়ানো’ বলা হয়, তা সভ্যতার আদিকাল থেকে চলে আসা এক আচার। প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে স্বাভাবিক আচরণের বাইরে কোনও মানুষকে যেতে দেখলে অনেক সময়েই মনে করা হত, তার উপরে কোনও অপশক্তি ভর করেছে। আদিম সমাজে এই অপশক্তি তাড়ানোর জন্যই আবির্ভাব হয় ওঝা তথা শামানদের। পরবর্তী কালে সংহত চেহারায় যখন ধর্মের প্রচলন শুরু হয়, তখনও থেকে যায় এই বিশ্বাস। খ্রিস্ট ধর্মে এগজ়রসিজ়ম প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদাপ্রাপ্ত। ক্যাথলিক খ্রিস্ট ধর্মে যাজকদের মধ্যে অনেকেই এগজ়রসিস্টের কাজ শুরু করেন। আজও টিকে রয়েছে এই প্রথা।
বিশ্বের এগজ়রসিজ়মের ইতিহাসে ভ্যাটিকানের যাজক গ্যাব্রিয়েল অ্যামর্থের (১৯২৫-২০১৬) নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। ডেমনোলজি (দানবতত্ত্ব) ও এগজ়রসিজ়ম বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। কথিত, তিনি কয়েক হাজার মানুষকে ‘প্রেতাবেশ’ থেকে উদ্ধার করেন। অবশ্য এই দাবি ও তাঁর কাজ নিয়ে গির্জার ভিতরেই বিপুল বিতর্ক বহমান থেকেছে। আজ নতুন করে অ্যামর্থ চর্চায় উঠে এসেছেন ‘দ্য পোপ’স এগজ়রসিস্ট’ নামে এক হলিউডি ছবির সূত্রে।
অ্যামর্থের জন্ম ইটালির মডেনা প্রভিন্সের এমিলিয়া-রোমানা জনপদে। ১৯৫৪ সালে তিনি রোমান ক্যাথলিক যাজকের জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ সালে অ্যামর্থকে ‘ডায়োসেস অফ রোম এগজ়রসিস্ট’ হিসাবে নিয়োগ করে। ১৯৯০ সালে তিনি আরও পাঁচ জন যাজককে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসসিয়েশন অফ এগজ়রসিস্টস নামের এক সংগঠন। ২০০০ সাল পর্যন্ত অ্যামর্থ এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন।
২০০০ সাল নাগাদ অ্যামর্থ দাবি করেন, তিনি প্রায় ৫০ হাজার এগজ়রসিজম ক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। এই ক্রিয়াগুলির কোনওটি ছিল কয়েক মিনিটের, কোনওটি আবার চলেছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। ২০১০ সালে অ্যামর্থ জানান, তাঁর করা এগজ়রসিজ়মের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
এগজ়রসিজ়মে সর্বদাই যে ‘প্রেতাত্মা’র আবেশ ঘটে, তা নয়। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার ‘অপশক্তি’ ভর করে মানুষের উপর। খ্রিস্টীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই ধরনের আবেশ নিয়ন্ত্রিত হয় শয়তান বা ডেভিলের দ্বারা। শয়তান ঈশ্বরের রাজত্ব থেকে মানুষকে বার করে আনতে সদা তৎপর। এগজ়রসিস্টের কাজ শয়তানের সেই উদ্দেশ্যে বাধা দেওয়া এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা।
অ্যামর্থের এই দাবিকে অনেকেই অবিশ্বাস্য বলে মনে করেন। ক্যাথলিক ক্যানন ল বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড পিটার্সও সন্দেহ প্রকাশ করেন অ্যামর্থের দাবি নিয়ে। অ্যামর্থ অবশ্য জানিয়েছিলেন, যে ৩০ হাজার এগজ়রসিজ়মে তিনি একক ভাবে কাজ করেছিলেন, তার মধ্যে মাত্র ৯৪টি ঘটনায় আক্রান্তরা ‘অপশক্তি’র দ্বারা পুরোপুরি আবিষ্ট হয়েছিলেন। পিটার্স জানান, এই দাবি যদি মেনেও নেওয়া যায়, তা হলেও দিনে অন্তত সাতটির বেশি এগজ়রসিজ়ম অ্যামর্থকে করতে হয়েছে। যেটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। কেননা, একেকটি এগজ়রসিজ়মের আচার সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লাগার কথা।
এই সন্দেহের নিরসন ঘটাতে অ্যামর্থ জানান, একেক সময় এক জন ব্যক্তির উপরে একাধিক ‘অপশক্তি’ বা ‘ডেমন’ ভর করেছে। সেই সব ক্ষেত্রে এক জনের উপরেই একাধিক এগজ়রসিজ়ম ক্রিয়া চালাতে হয়েছে। অ্যামর্থের মতে, কখনও কখনও আক্রান্তের উপর হাজারেরও বেশি ‘অপশক্তি’ ভর করেছিল।
বলাই বাহুল্য, অ্যামর্থকে নিয়ে বিতর্ক বহমান ছিল ক্যাথলিক চার্চের নিজস্ব পরিসরেই। কিন্তু অ্যামর্থ তাঁর আদর্শে অবিচল ছিলেন। এগজ়রসিজ়মকে তিনি ব্রত হিসেবেই দেখেছিলেন।
কী ভাবে শয়তান বা তার অনুচরেরা মানুষের উপর ভর করে? এই প্রশ্নের সামনে বার বার পড়তে হয়েছিল অ্যামর্থকে। তিনি জানিয়েছিলেন, খ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাস হারানো, বিভিন্ন কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ, ‘কালো জাদু’, ‘স্যাটান উপাসনা’ অথবা উইজা বোর্ডের দ্বারা ‘প্রেত’ বা ‘অপশক্তি‘ আহ্বানের মতো কাজই মানুষকে শয়তানের কাছাকাছি নিয়ে যায়। তখন মানুষ সহজেই অপশক্তির শিকার হয়ে পড়েন।
ঠিক এর পরেই যে প্রশ্নটির সম্মুখীন অ্যামর্থকে বার বার হতে হয়েছিল, সেটি এই— কী ভাবে এই ‘প্রেতাবেশ’ বা অপশক্তির কবল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? অ্যামর্থের উত্তর ছিল খুবই সহজ-সরল। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রথাসিদ্ধ প্রার্থনা, অর্থের প্রতি লোভহীনতা এবং দীনাতিদীন জীবনযাপন তাঁকে অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর ক্ষমতা দান করেছে।
অ্যামর্থ তাঁর সারা জীবনের এগজ়রসিজ়মের অভিজ্ঞতা লিখে গিয়েছেন দু’টি গ্রন্থে— ‘অ্যান এগজ়রসিস্ট টেলস হিজ স্টোরি’ এবং ‘অ্যান এগজ়রসিস্ট: মোর স্টোরিজ’। এই দু’টি বইকে রোমান ক্যাথলিক ডেমনোলজি সংক্রান্ত পড়াশোনার অন্যতম আকর হিসাবে ধরা হয়। এর বাইরে দানবতত্ত্ব ও অন্যান্য অতিপ্রাকৃত বিষয়ে অ্যামর্থ প্রায় ৩০টি বই লিখে গিয়েছেন।
এক সাক্ষাৎকারে অ্যামর্থ জানিয়েছিলেন, যদি কেউ এসে তাঁকে বলতেন যে তাঁর উপর অপশক্তি ভর করেছে, তা হলে কখনওই তিনি তাঁর ক্রিয়া শুরু করতেন না। প্রথমেই তিনি তেমন ব্যক্তিকে মনোবিদ বা চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর মতে, অশুভ আবেশের কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে। সেগুলি বিচার না করে এগজ়রসিজ়মের ক্রিয়ায় এগোনো উচিত নয়।
এই সব কর্মকাণ্ডের জন্য বার বার বিতর্ক দানা বেঁধেছে অ্যামর্থকে নিয়ে। কিন্তু নিজের বিশ্বাস থেকে একবিন্দু সরে আসেননি অ্যামর্থ। এক বার তিনি যোগাভ্যাসের বিরুদ্ধে কথা বলায় তুমুল হইচই শুরু হয়। আর এক বার হ্যারি পটার সিরিজের পড়ুয়ারা সহজেই শয়তানের কবলে পড়বেন বলে রীতিমতো ফ্যাসাদে পড়েন অ্যামর্থ।
এক বার অ্যামর্থকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে শয়তান প্রবেশ করতে পারে কি না। অ্যামর্থের উত্তর ছিল, “অবশ্যই পারে।” তিনি জানান, ১৯৮১ সালে ভ্যটিকানের অন্দরে শয়তান প্রবেশ করেছিল। সেই সময় পোপ দ্বিতীয় জন পলকে হত্যার চেষ্টা করে এক বিশেষ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। আলি আদজা নামে এক তুর্কি আততায়ী পোপকে হত্যার চেষ্টা করেন। অ্যামর্থের মতে, আদজাকে যাঁরা অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন, তাঁরা শয়তানের অনুপ্রেরণাতেই চালিত হয়েছিলেন।
সারা জীবন বিতর্কের কেন্দ্রে থাকলেও পশ্চিমি বিশ্বে অ্যামর্থ ছিলেন রীতিমতো খ্যাতনামী ব্যক্তি। তাঁর ভক্তসংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। অ্যামর্থের দুই পর্বে লিখিত স্মৃতিকথা আদৃত হয়েছে পাঠকমহলে। এমনকি যাঁরা এগজ়রসিজ়মে বিশ্বাস করেন না, তাঁরাও রাত জেগে অ্যামর্থের স্মৃতিকথা পড়েছেন তার সাহিত্যগুণের জন্য, ভয়াল রসের সুদক্ষ বিবরণের জন্য।
২০১৬ সালে ৯১ বছর বয়সে প্রয়াত হন গ্যাব্রিয়েল অ্যামর্থ। মৃত্যুর পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা বা তাঁকে ঘিরে মানুষের কৌতূহল কমেনি। ২০১৭ সালে অ্যামর্থকে নিয়ে ‘দ্য ডেভিল অ্যান্ড ফাদার অ্যামর্থ’ নামে এক তথ্যচিত্র তৈরি করেন আমেরিকান পরিচালক উইলিয়াম ডেভিড ফ্রিডকিন। ২০২৩-এ অ্যামর্থের স্মৃতিকথার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে ‘দ্য পোপ’স এগজ়রসিস্ট’ ছবিটি। এখানে অ্যামর্থের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে রাসেল ক্রো-র মতো খ্যাতনামী তারকাকে।
অ্যামর্থকে মানুষ চিনতেন ‘পোপ’স এগজ়রসিস্ট’ হিসাবেই। ভ্যাটিকানও তাঁকে, তাঁর কাজকে সেই মর্যাদা দিয়েই দেখেছিল। এগজ়রসিজম সত্য কি অসত্য, বাস্তব কি অবাস্তব— অ্যামর্থের জীবন নিয়ে ভাবতে বসলে এ কথা মনে থাকে না। এক জন মানুষ যে অটল বিশ্বাসের সঙ্গে শুভশক্তির প্রচার করে গিয়েছেন সারা জীবন, সে কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।