প্লাম কেক হোক বা ফ্রুট কেক— বড়দিন এলেই বেকারিতে নানা রকমের কেকের সমাহার দেখা যায়। সেই কেক কিনতে ভিড়ও হয় প্রবল। বড়দিনে কেক বানানোর রীতি বিদেশি হলেও ভারত এই রীতি আপন করে নিয়েছিল বহু আগেই। তার নেপথ্যকাহিনিও বেশ চমকপ্রদ।
১৮৮৩ সালের ঘটনা। মারডক ব্রাউন নামে ব্রিটেনের এক ব্যবসায়ী দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। বড়দিন আসন্ন। কিন্তু মারডক নিজের দেশ থেকে দূরে। তাই দুধের স্বাদ ঘোল খেয়ে মেটানোর চিন্তাভাবনা করেছিলেন তিনি। বড়দিন উপলক্ষে কেক খাবেন বলে স্থির করেন মারডক। কিন্তু ভারতে কেক পাবেন কোথায়? উপায় খুঁজে না পেয়ে তিনি চলে গেলেন এক বিস্কুট তৈরির কারখানায়।
কেরলের সেই বিস্কুট তৈরির কারখানার মালিকানা ছিল জনৈক মামবালি বাপুর হাতে। বাপুর কাছে গিয়ে মারডক আর্জি জানান যে বড়দিন উদ্যাপন করবেন বলে তাঁকে একটি কেক বানিয়ে দিতে হবে। কিন্তু পাউরুটি এবং বিস্কুট বানাতে দক্ষ হলেও কেক কী ভাবে বানাতে হয় সেই বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও ছিল না বাপুর। সেই সমস্যার সমাধান করেন খোদ মারডক।
দক্ষিণ ভারতে মালাবার উপকূলে স্কট নামের এক জন দারুচিনির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ব্রিটেনে তাঁর যাওয়া-আসা লেগেই থাকত। মারডক কেক খেতে চেয়েছেন শুনে ব্রিটেন থেকে একটি কেক আনিয়ে ফেললেন স্কট। তার পর সেই কেক নিয়ে গেলেন বাপুর কাছে।
কেক কী ভাবে তৈরি করা হয় তা বাপুকে শেখালেন স্কট। মনে ভয় থাকলেও ব্রাউন সাহেবের নির্দেশ অনুযায়ী কেক বানানো শুরু করলেন বাপু। মারডক তাঁকে জানিয়েছিলেন, কেক তৈরির সময় সামান্য ব্র্যান্ডি ব্যবহার করলে কেকের স্বাদ বাড়ে। নিকটবর্তী ফরাসি এলাকা মাহে থেকে ব্র্যান্ডি আনাতেও বলেছিলেন মারডক। কিন্তু তার পরিবর্তে কাজু এবং আপেলের একটি মিশ্রণ দিয়ে কেক বানিয়ে ফেললেন বাপু।
দেশীয় উপকরণ দিয়েই সম্পূর্ণ কেকটি বানিয়েছিলেন বাপু। স্বাদে আলাদা হওয়ায় তা মারডকের পছন্দ হবে কি না তা নিয়ে ধন্দে ছিলেন তিনি। মারডক কিন্তু এই অভিনব পদ্ধতিতে বানানো কেক খেয়ে মুগ্ধ হয়ে যান। শুধু তা-ই নয়, এমন আরও এক ডজন কেক বানানোর অর্ডার দেন বাপুকে।
নতুন ধরনের কেক, তাই নামও নতুন দেওয়া দরকার। বাপু এই কেকের নাম রাখলেন ‘প্লাম কেক’। অনেকে দাবি করেন, এটিই বড়দিন উপলক্ষে ভারতে বানানো প্রথম কেক। যদিও এর কোনও লিখিত প্রমাণ নেই। বাপুর ভাইপোর প্রপৌত্র প্রকাশ মামবালি এক সাক্ষাৎকারে তাঁদের পরিবারের ১৪০ বছরের পুরনো ইতিহাসকে তুলে ধরে এই দাবি করেন।
প্রকাশ জানান, মামবালির হাত ধরে যে ইতিহাসের সূত্রপাত হয়েছিল, ১৪০ বছর ধরে সেই ধারাই বয়ে নিয়ে চলেছে পরিবারের বংশধরেরা। এখনও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে কেক বানিয়ে যাচ্ছে ওই বেকারির কর্মীরা।
চার প্রজন্ম ধরে প্লাম কেকের সেই জনপ্রিয়তা বজায় রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশ। ভারতীয়দের সামনে ব্রিটেনের স্বাদ তুলে ধরেছিলেন বাপু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হাতে তৈরি কেক এবং মিষ্টি সৈন্যদের জন্য পাঠিয়েছিলেন বাপু।
দেশ জুড়ে বিভিন্ন নামে দোকান থাকলেও তাঁদের আসল বেকারি থালাসেরিতে অবস্থিত। প্রকাশের ঠাকুরদা গোপাল কেরলে এই ব্যবসা আরও ব়ৃদ্ধি করেন। গোপালের ১১ জন ছেলেও বড় হয়ে এই পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন।
প্রথা অনুযায়ী কেক বানালেও তাঁরা কেকের স্বাদবদলের জন্য নতুন ধরনের ‘ফ্লেভার’ যোগ করেন। এখনও পর্যন্ত ২৪ ধরনের কেক বানিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছে তাঁদের বেকারি।
প্রকাশের স্ত্রী লিজির মন্তব্য, শুধু কেরলেই নয়, প্লাম কেকের চাহিদা দেশ জুড়ে। বড়দিন আসার আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্লাম কেকের অর্ডার আসে। বেশির ভাগ অর্ডার মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই এবং বেঙ্গালুরু থেকে আসে বলে জানিয়েছেন লিজি।
ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই নির্দিষ্ট ঠিকানায় প্লাম কেক পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে লিজি জানিয়েছেন, প্রতি বছর কেক তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় নভেম্বর মাস থেকেই।
কেক প্রস্তুতির জন্য যে উপকরণগুলি ব্যবহার করা হয় তা ১ মাস আগে থেকে ওয়াইনে ডুবিয়ে রাখেন বেকারির কর্মীরা। ভারতে সর্বপ্রথম বড়দিনের কেক তৈরি করেছিল বাপু। এখনও ওই বেকারি তার নাম ধরে রেখেছে।
বড়দিনের কেক তৈরির ক্ষেত্রে কেরল বিশ্বে মাইলফলক গড়ে ফেলেছে। ২০২০ সালে বিশ্বের লম্বা কেক তৈরি করে ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড’-এ নজির গড়েছে কেরল। চিন যেখানে ৩.২ কিমি দীর্ঘ কেক তৈরি করে নজির গড়েছিল, ৫.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ কেক বানিয়ে তা ভেঙে দিয়েছে কেরল।