মুম্বই। স্বপ্ননগরী। জীবনের স্বপ্নপূরণের আশায় অনেকেই পা রাখেন এই শহরে। কেউ জনতার ভিড়ে হারিয়ে যান, কেউ আবার সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করেন। এই দুই বিভাজনরেখার মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইসক্রিম প্রস্তুতকারী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দন কামাথ।
রঘুনন্দনের জন্ম ১৯৫৪ সালে কর্নাটকের মুলকি গ্রামে। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন তিনি।
পেশায় রঘুনন্দনের বাবা ছিলেন ফল বিক্রেতা। মাটির বাড়িতে বাবা-মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গে থাকতেন রঘুনন্দন।
ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় বেশি আগ্রহ ছিল না রঘুনন্দনের। খেলাধুলো করে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন তিনি।
পর পর দু’বার বোর্ডের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন রঘুনন্দন। তাঁর পরিবার আর্থিক ভাবে সচ্ছল ছিল না। তাঁর বড় দাদা থাকতেন মুম্বইয়ে। তাঁকে সাহায্য করার জন্য ১৫ বছর বয়সে কর্নাটক থেকে রঘুনন্দন পাড়ি দেন মুম্বই।
মুম্বইয়ে একটি ছোট দোকানে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার বানাতেন রঘুনন্দনের দাদা। দাদার সঙ্গে কাজ করতে করতে রঘুনন্দন সেখানে তাঁর নিজের হাতে বানানো আইসক্রিম বিক্রি করতে শুরু করেন।
এই আইসক্রিম বানাতে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা এল রঘুনন্দনের মাথায়। তিনি ভাবলেন, চকোলেট এবং ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম বহুল প্রচলিত। এই আইসক্রিমের স্বাদে কোনও ভাবে বদল আনলে কেমন হয়?
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। আইসক্রিমের মধ্যে ফলের স্বাদ নিয়ে আসবেন, এমনটাই সিদ্ধান্ত নিলেন রঘুনন্দন।
আইসক্রিম নয়, খেয়ে মনে হবে যেন আস্ত ফলই খাচ্ছেন। বাবা ফল বিক্রেতা হওয়ায় ভাল ফল চিনতেও অসুবিধা হয়নি রঘুনন্দনের।
কাঁঠাল, তরমুজ থেকে শুরু করে যাবতীয় ফলের শাঁসের সঙ্গে চিনি, দুধ মিশিয়ে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আইসক্রিম বানাতেন রঘুনন্দন। আইসক্রিম বিক্রির জন্য আলাদা একটি দোকান খুললেন তিনি।
২০০ বর্গফুট এলাকার একটি দোকান। সামনে ছ’টি টেবিল পাতা। মুম্বইয়ে জুহুর কোলিওয়াড়া এলাকায় আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেন রঘুনন্দন।
আইসক্রিম বিক্রির পাশাপাশি পাও ভাজি বিক্রি করতেন রঘুনন্দন। ব্যবসার পথে বহু চড়াই-উতরাইয়ের পর অবশেষে ১৯৮৪ সালে চার জন কর্মীকে নিয়ে জুহুর ভিলে পার্লে এলাকায় নিজের প্রথম দোকান খুললেন তিনি।
শুরুর দিকে মাত্র ১০ রকমের আইসক্রিম বানানো হত রঘুনন্দনের দোকানে। ধীরে ধীরে তিনি বিভিন্ন ধরনের ফল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। বর্তমানে তাঁর সংস্থার তরফে ১২৫টিরও বেশি স্বাদের আইসক্রিম তৈরি করা হয়।
সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন শহরের প্রান্তে মোট ১৩৫টি দোকান রয়েছে রঘুনন্দনের। ২০২০ সালের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন রঘুনন্দন।
এমনকি, অতিমারি চলাকালীন একটি সমীক্ষা করে জানা যায়, দেশের প্রথম ১০টি আইসক্রিম প্রস্তুতকারী সংস্থার মধ্যে নাম লিখিয়েছে রঘুর সংস্থা।
রঘুনন্দন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, নিজের সংস্থার প্রচারের জন্য তিনি এক পয়সাও খরচ করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভাল মানের আইসক্রিম বানালে লোকের মুখে মুখেই সে কথা প্রচার হয়ে যাবে। আলাদা করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার করার কোনও প্রয়োজন নেই বলে মনে করতেন রঘুনন্দন।
হলও তা-ই। মুম্বইবাসী থেকে শুরু করে টিনসেল নগরীর জনপ্রিয় তারকারা রঘুনন্দনের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে রঘুনন্দন নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে বলেন, ‘‘১৯৮৬ সালের ঘটনা। আমি টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান দেখছিলাম। শোটির সঞ্চালনা করছিলেন সুনীল গাওস্কর।’’
রঘুনন্দন জানান, সেই শোয়ে ভিভিয়ান রিচার্ডসের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন সুনীল। রঘুনন্দন বলেন ‘‘শো চলাকালীন হঠাৎ শুনলাম, তৎকালীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ভিভিয়ান বলছেন, আমাদের দোকানের আইসক্রিম তাঁর ভাল লেগেছে। এই প্রাপ্তিগুলোই আমার মন ভরিয়ে দিত।’’
১৫ বছর বয়সে যে যুবকটি নিজের স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন, এখন তিনি বিশ্ব জুড়ে ‘আইসক্রিম ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ নামে খ্যাত।