আমেরিকায় তখন চলছে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’। সেই সুযোগে বাড়তি রোজগার করার চেষ্টা করেছিলেন মেক্সিকোর ব্যবসায়ী লিওন ট্রাবুকো। সে জন্য তিনি কিনেছিলেন টন টন সোনা। ভাগ্যের পরিহাসে সেই সোনা আর বেশি দামে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়নি ট্রাবুকোর। সেই সোনা কোথায় গেল, কী হল, আজও অধরা সেই রহস্য।
সময়টা ১৯৩৩। মেক্সিকোর কুয়েরনাভাকায় গোপন বৈঠকে বসেছিলেন সে দেশের চার ব্যবসায়ী। ট্রাবুকো ছাড়াও ছিলেন ব্যাঙ্কার রাফায়েল বোরেগা, ব্যবসায়ী রিকার্ডো আর্টেগা, কার্লোস সেপালভেদা। আলোচ্য বিষয় ছিল একটাই। কী ভাবে সোনার ব্যবসায় লাভ করা যায়।
আমেরিকায় তখন আর্থিক বিপর্যয় চলছে। ওই পরিস্থিতিতে প্রতি আউন্স সোনার দাম প্রায় ১০ ডলার বৃদ্ধি করেছিল সে দেশের সরকার। বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় আট হাজার টাকা।
এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন ট্রাবুকোরা। চেয়েছিলেন, মেক্সিকো থেকে কম দামে সোনা কিনে আমেরিকার বাজারে বিক্রি করবেন। ট্রাবুকোরা বুঝেছিলেন, আমেরিকার বাজারে সোনার দাম আরও বাড়বে। অপেক্ষা করে বসেছিলেন, কখন দাম আরও বাড়বে আর তারা সোনা বিক্রি করে লাভবান হবেন।
চার ব্যবসায়ী এর পর মেক্সিকোর ছোটখাটো খনির মালিকদের থেকে সোনা কিনতে থাকেন। আমেরিকায় সোনা চোরাচালান করতে গিয়ে ধরা পড়লে জেল অবশ্যম্ভাবী। জেনেও পিছিয়ে আসেননি ট্রাবুকোরা।
শোনা যায়, ট্রাবুকো এবং তাঁর তিন সঙ্গী মিলে ১৬ টন সোনা কিনেছিলেন। মেক্সিকোর ছোটখাট খনি মালিকের থেকে কম দামে সে সব সোনা কিনেছিলেন তাঁরা।
সোনা তো কেনা হল, এ বার সেগুলো রাখা হবে কোথায়? কারণ আমেরিকার পুলিশ, গোয়েন্দাদের কানে গেলে রক্ষে নেই। সে জন্য সোনা রাখার জায়গা খুঁজতে শুরু করেন ট্রাবুকো।
জায়গা তাঁর চোখেও পড়ে। শোনা গিয়েছে, নিউ মেক্সিকোর ফার্মিংটনের একটি জায়গায় সে সব সোনা লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। সে জন্য রেড ময়সার নামে এক বিমানচালককে নিযুক্ত করেছিলেন তিনি।
সোনার পরিমাণ ছিল বিশাল। তাই খনি থেকে সোনা কেনার পর বার বার সেই বিমানে চাপিয়ে ফার্মিংটনে মাটির নীচে সোনা পুঁতে এসেছিলেন ট্রাবুকো। কোথায় সোনা রাখা হয়েছিল, সেই জায়গা তিনি ছাড়া আর কেউ জানতেন না। এমনকি বিমানচালকেরও কোনও ধারণা ছিল না।
১৯৩৩ সালের ১৪ জুলাই সোনা লুকনোর কাজ শেষ হয়। কোনও কোনও ইতিহাসবিদ মনে করেন, ট্রাবুকো যত সোনা কিনেছিলেন, তা যদি বিক্রি করা যেত, তা হলে সেই আমলেই ৭০ লক্ষ ডলার লাভ করতেন তাঁরা।
১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজ়ভেল্ট সোনা সংরক্ষণ আইন (গোল্ড রিজার্ভ অ্যাক্ট)-এ সই করেন। তাতে বলা হয়, আমেরিকায় যত সোনা রয়েছে, তা সরকারি কোষাগারে রাখতে হবে। কেউ ব্যক্তিগত ভাবে সোনা নিজের কাছে রাখতে পারবেন না। ফলে আমেরিকায় সোনা কেনাবেচাই একপ্রকার নিষিদ্ধ হয়।
নতুন এই আইনের কারণে ট্রাবুকোদের মাথায় হাত পড়ে। আমেরিকায় সোনা বিক্রি করে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। বছরের পর বছর কেটে যায়। আমেরিকার আইনে বদল আসেনি। ইতিমধ্যে মারা যান ট্রাবুকোর তিন অংশীদার। তাঁরা যদিও জানতেন না সোনা কোথায়।
১৯৪৬ সালে ট্রাবুকোর চোরাচালানের বিষয়টি গোয়েন্দাদের নজরে আসে। সোনা কিনে লুকিয়ে রাখার বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসে। শুরু হয় তদন্ত। অভিযোগ ওঠে, আমেরিকার সোনা সংরক্ষণ আইন ভেঙেছেন তিনি।
একটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, ট্রাবুকোকে একটি প্রস্তাব দেয় আমেরিকা। বলে, সোনার ঠিকানা জানাতে। বদলে তিনি সোনার মালিকানা চেয়ে আইনি পথে লড়তে পারবেন।
ট্রাবুকো এই প্রস্তাব মানেননি। তিনি স্পেনে পালিয়ে যান। তার পর এক দিন স্পেনে তাঁর মৃত্যুও হয়। কবে, কোথায়, সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য মেলেনি। কিন্তু তার ফলে লুকিয়ে রাখা সোনার আর সন্ধান মেলেনি।
গুপ্তধনের সন্ধানী এড ফস্টার নিউ মেক্সিকোর ফার্মিংটনের পাশে মরুভূমিতে ৩৫ বছর ধরে টানা খোঁজ করেছিলেন সেই সোনা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন।
এক মহিলা জানিয়েছিলেন, ১৯৩৩ সালে তাঁর ছ’বছর বয়স ছিল। সে সময় প্রায় দিনই একটি বিমান ফার্মিংটনে নামত আবার উড়ে যেত। সেই বিমান যেখানে নামত, মহিলার থেকে জেনে তার আশপাশেও খোঁজ করেছিলেন ফস্টার। লাভ হয়নি। প্রায় ৯০ বছর কেটে গেলেও সেই বিপুল পরিমাণ সোনার খোঁজ অধরাই রয়ে গিয়েছে।