সে গ্রামের বাতাসে নাকি সব সময় ভেসে বেড়ায় কারও আর্তনাদ। কেউ যদি ভুল করেও সেই গ্রামে ঢুকে পড়ে, তা হলে তার বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রায়শই সেই গ্রামকে নিয়ে লেখালিখি হয় পত্রপত্রিকায়। কিন্তু, সেই গ্রামটিকে খুঁজে পাওয়া দুরূহ। কারণ দেশের মানচিত্রে কোথাও সেই গ্রামটিকে দেখতে পাওয়া যায় না। জাপানের ইনুনাকি নামের গ্রামটিকে তাই ‘ভূতুড়ে গ্রাম’ বলে ডাকেন অনেকে। কিন্তু অতিপ্রাকৃত বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রামটি নিজেই একটা প্রহেলিকা। সে নিজেই যেন এক ‘প্রেত’।
জাপানের মানচিত্রে খোঁজ পাওয়া না গেলেও কিংবদন্তিতে রীতিমতো ‘জীবন্ত’ ইনুনাকি গ্রাম। লোক পরম্পরায় জানা যায়, ফুকুয়োকা প্রিফেকচারে নাকি এই গ্রাম অবস্থিত। এর এক দিকে ইনুনাকি পর্বত, অন্য দিকে ইনুনাকি গাওয়া নামে এক নদী। জনশ্রুতি, এই গ্রামের বাসিন্দারা দেশের সংবিধান একেবারেই মানতে রাজি নন। গ্রামের বাইরে নাকি একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া রয়েছে যে— “এই গ্রামে জাপানের সংবিধান কার্যকর নয়।”
এ হেন গ্রামটি খুঁজে পেতে হলে প্রাচীন এক সুড়ঙ্গের পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তা খুঁজতে হবে, এমন কথাই বলে স্থানীয় জনশ্রুতি। এ কথাও জানা যায়, ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে এক তরুণ যুগল হিসায়ামা শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎই তাঁদের গাড়িটি বিগড়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে তাঁরা ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে এক জঙ্গলে প্রবেশ করেন। সেই জঙ্গলের ভিতরেই এক পরিত্যক্ত গ্রাম দেখতে পান তাঁরা। আকস্মিক ভাবে তাঁদের উপর এক উন্মাদ বৃদ্ধ কাস্তে হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাঁদের হত্যা করেন।
জনশ্রুতি আরও জানায় যে, ইনুনাকি সেতুর কাছে জনবিরল এক জায়গায় একটি টেলিফোন বুথ রয়েছে। আপাত ভাবে অদৃশ্য ইনুনাকি গ্রাম থেকে প্রতি রাতে সেখানে একটা ফোন আসে। কেউ যদি উত্তর দেওয়ার জন্য বুথ থেকে ফোনটি তোলেন, তা হলে তাঁর উপর নেমে আসে মারাত্মক অভিশাপ। তিনি বাস্তব পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যান এবং অদৃশ্য গ্রাম ইনুনাকির বাসিন্দা হয়ে পড়েন। অভিশপ্ত মানুষটির নাকি নিজের দেহ বা মনের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণই থাকে না।
এই সব কাহিনি শুনলে মনে হতেই পারে, এ সব নেহাতই ছেলেভোলানো গপ্পো। কিন্তু জাপানের এক বড় অংশের মানুষ ইনুনাকি গ্রামটিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং আজও করে চলেছেন। পুরনো দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, তোকুগাওয়া জমানায় (১৬০৩-১৮৬৭) ওই অঞ্চলে ইনুনাকিদানি নামে সত্যিই এক গ্রাম ছিল। গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল চিনামাটির সামগ্রী তৈরি করা। ১৮৮৯ সালে এই গ্রামটিকে ইয়োশিকাওয়া নামের আর একটি গ্রামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। আরও পরে অন্যান্য এলাকা যুক্ত হতে থাকলে ইনুনাকিদানি তার অস্তিত্ব হারায়।
ইনুনাকি গ্রামকে নিয়ে বিভিন্ন ‘ভূতুড়ে’ কিংবদন্তির মূলে নাকি রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। আসলে ইনুনাকি টানেল নামে দু’টি সুড়ঙ্গ রয়েছে। প্রথমটি তৈরি হয় ১৯৪৯ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৭৫-এর আশপাশে। পুরনো সুড়ঙ্গটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। তাকে ঘিরে ছড়াতে থাকে বিচিত্র সব কাহিনি।
১৯৮৮ সালে পাঁচ জন তরুণ এক কারখানা শ্রমিককে অপহরণ করে পুরনো সুড়ঙ্গে নিয়ে এসে অত্যাচার করে হত্যা করে। এই পাঁচ জন ওই শ্রমিকের গাড়ি চুরি করার চেষ্টা করেছিল। খুন করার পরে ওই সুড়ঙ্গের ভিতরেই তারা শ্রমিকের দেহ পুড়িয়ে দেয়। পরে ওই পাঁচ জন ধরা পড়ে এবং তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
ওই শ্রমিকের আত্মা নাকি সুড়ঙ্গে বাস করে এবং সে ভয়ানক প্রতিশোধপ্রবণ। ২০০০ সালে ইনুনাকিগাওয়া নদীর বাঁধের কাছে এক ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ার পর থেকে এই কাহিনি আরও বেশি করে ছড়াতে শুরু করে।
১৯৯৯ সালে জাপানের এক টেলিভিশন চ্যানেলে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির কাছ থেকে একটি চিঠি এসে পৌঁছয়। সেই চিঠিতে তরুণ যুগলের হত্যার কথা উল্লেখ করে সেই চ্যানেলের সাংবাদিকদের ওই এলাকায় অনুসন্ধান চালাতে অনুরোধ করা হয়। সেই চিঠির শিরোনাম ছিল— ‘জাপানের অংশ নয় যে গ্রাম’।
আজকের এই উপগ্রহ এবং ড্রোন প্রযুক্তির যুগে একটি গ্রামকে খুঁজে পাওয়া তেমন কোনও ব্যাপারই নয়। রহস্য-রোমাঞ্চ নিয়ে কারবার করে, এমন বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেল ইনুনাকি গ্রামকে খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে বলে শোনা যায়। কিন্তু কেউই আজ পর্যন্ত সেই গ্রামের সন্ধান পায়নি।
অলৌকিকত্বকে সরিয়ে রেখে দেখলে অনুমান করা যায়, ইনুনাকি নামে একটি জনপদ সংশ্লিষ্ট এলাকায় এককালে সত্যিই ছিল। কিন্তু বার বার তাকে অন্য জনপদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় সে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারায়। গ্রামবাসীরাও অন্য জনপদের বাসিন্দা হিসাবে পরিচিত পান। ইতিহাস আর ভূগোলের পাতা থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় ইনুনাকি গ্রাম।
এই মুহূর্তে বিশ্বে হরর সিনেমা ও সাহিত্যে জাপান এক নজরকাড়া জায়গায়। ইনুনাকি গ্রাম নিয়ে জাপানের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। ২০১৯ সালে তাকাশি শিমিজু পরিচালিত ‘হাওলিং ভিলেজ’ নামের একটি হরর ছবি মুক্তি পায়, যার কেন্দ্রে ছিল ইনুনাকি গ্রামকে ঘিরে প্রচলিত কিংবদন্তি। তবে তার আগে ২০১৬ সালে ‘দ্য লস্ট ভিলেজ’ নামের এক অ্যানিমেশন টেলিভিশন সিরিজ নির্মিত হয়। ইনুনাকি টানেলকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ভিডিয়ো গেমও। তবে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, জাপানের নামজাদা ম্যাঙ্গা (গ্রাফিক নভেল) লেখক জুনজি ইতো ইনুনাকির কিংবদন্তি নিয়ে লিখেছেন ‘দ্য স্টোরি অফ দ্য মিস্টিরিয়াস টানেল’।