অদ্ভুত এক দ্বীপ। তাতে নেই একটাও গাছ। আসে না পাখি। জনহীন দ্বীপে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু অদ্ভুত পাথরের মূর্তি। এক একটি ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা। ঠিক যেন যক্ষের মতো তারা আগলে রেখেছে গোটা দ্বীপকে। সেই ইস্টার দ্বীপ নিয়ে হাজারো প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। কাটেনি রহস্য।
দ্বীপটির দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। চওড়ায় ১৬ কিলোমিটার। আদতে চিলির অধীনস্থ এই দ্বীপ। তবে চিলির মূল ভূখণ্ড এই দ্বীপ থেকে ৩০০০ কিলোমিটার দূরে। তাই প্রশ্ন ওঠে, নিভৃত এই দ্বীপে এসে এই বিশাল মূর্তি গড়ল কে?
১৭২২ সালের এক ইস্টার রবিবার এই দ্বীপ আবিষ্কার করেন ডাচ অভিযাত্রী জেকব রগ্গিভিন। তাই দ্বীপের নাম দিয়েছিলেন ইস্টার আইল্যান্ড। এর অন্য নাম রোপা নুই। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের উপর রয়েছে দ্বীপটি।
মনে করা হয় দ্বাদশ শতকে এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছিলেন জনজাতির মানুষ। মূলত প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে এসেছিলেন তাঁরা। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল জনবসতি।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ১৪০০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে পাথর খোদাই করে গোটা দ্বীপে প্রায় ৮০০ মোয়াই খোদাই করা হয়। এক একটি শিলা খোদাই করে এক একটি মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। এক একটির ওজন কয়েক টন। কয়েকটি আবার ৩০ ফুট পর্যন্ত উচু। এই মূর্তিগুলিকেই মোয়াই বলা হয়।
দ্বাদশ শতকে এই দ্বীপে যখন জনবসতি তৈরি হয়, তখন লোকসংখ্যা ছিল তিন থেকে চার হাজার জন। ১৮৭৭ সালে ইউরোপীয়রা যখন এই দ্বীপে পৌঁছয়, তখন সেখানকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১১১। কী ভাবে কমল জনসংখ্যা?
জনসংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে গাছও। এখন ইস্টার দ্বীপে একটিও গাছ নেই। এই নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয় গবেষকদের মনে। কেন গাছশূন্য এই দ্বীপ?
গবেষকরা জেনেছেন, গত ৩০ হাজার বছর ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপে ছিল তাল গাছের সারি। ১২০০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে গাছের সংখ্যা ক্রমে কমেছে। ইতিহাসবিদরা মনে করছেন, একের পর এক বিশাল প্রস্তর মূর্তি তৈরি হয়েছে। সেগুলি পরিবহণের জন্য ব্যবহার করা হত তালগাছ। সম্ভবত ওই তালগাছে দড়ি বেঁধে গড়িয়ে গড়িয়ে মূর্তিগুলিকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হত।
পাথরের মূর্তি পরিবহণের জন্য কোপ পড়তে থাকে গাছে। একটা সময় সে কারণে বদলে যায় দ্বীপের বাস্তুতন্ত্র। বাসা তৈরির জন্য গাছ ছিল না। তাই পাখিরা মুখ ফেরায় ইস্টার আইল্যান্ড থেকে।
গাছ না থাকায় ভূমিক্ষয় শুরু হয়। দ্বীপের উর্বর জমিতে তখন চাষাবাদ অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বীপের বাসিন্দারা গাছ কেটে সেই কাঠ দিয়ে বা়ড়ি তৈরি করতেন। গাছ না থাকায় ঘরছাড়া হয়ে পড়েন তাঁরা। সে কারণে ক্রমেই দ্বীপের জনসংখ্যা কমতে থাকে।
তবে অনেকে মনে করেন, শুধু গাছ নয়, ইঁদুরের কারণেও দ্বীপটি জনশূন্য। দ্বীপে নাকি বেড়েছিল ইঁদুরের উৎপাত। তারা গর্ত খুঁড়ে মাটি আলগা করে দিয়েছিল। ফলে একের পর এক গাছ উপড়ে পড়ে যায়। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ইঁদুরের কারণে প্লেগ মহামারি ছড়ায়। তার কারণেও জনশূন্য হয় এই দ্বীপ।
জনশূন্য এই দ্বীপের পাশাপাশি মোয়াই নিয়ে কাটেনি রহস্য। এই মূর্তি তৈরি নিয়েও রয়েছে অনেক গল্প, জনশ্রুতি। বলা হয়, হোতু মাতু নামে এক রাজা সুন্দর এক দেশে বাস করতেন। সে দেশের নাম ছিল হিবা। এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন, ডুবে যাবে তাঁর দেশ। চিন্তায় পড়েন রাজা।
নতুন দেশ খোঁজার জন্য তিনি দেশের সাত অভিযাত্রীকে পাঠিয়ে দেন। জানান, এমন দেশ খুঁজতে হবে, যেখানে বাসের পাশাপাশি ইয়াম (এক ধরনের কচু) চাষ করা যাবে।
মনে করা হয়, ওই সাত জন সমুদ্রে ভেসে এসে পৌঁছেছিলেন ইস্টার আইল্যান্ডে। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন একটি মোয়াই। সেই দ্বীপে পুঁতে দেন ওই পাথরের তৈরি মোয়াই। রাজাকে খবর দিতে হিবায় ফিরে যান ছ’জন। নতুন সেই দ্বীপে থেকে যান এক জন।
পরে নিজের স্ত্রী, বোনকে নিয়ে নতুন দ্বীপে থাকতে আসেন হোতু মাতু। সঙ্গে ছিলেন ১০০ জন। সাত অভিযাত্রীকে সম্মান জানাতেই নাকি সাত মোয়াই তৈরি করেন রাজা। পরে ধীরে ধীরে আরও মোয়াই তৈরি করেন অধিবাসীরা।
এই মোয়াই নিয়ে অন্য একটি জনশ্রুতিও রয়েছে। মনে করা হয়, ওই দ্বীপের জনজাতিরা মোয়াইগুলি তৈরি করেছিলেন চাষাবাদে নজর রাখার জন্য। ওই মোয়াইদের জন্যই নাকি উর্বর হত মাটি। যদিও আজও স্পষ্ট নয়, কে বা কারা তৈরি করেছিলেন সেই মোয়াই? কেন তৈরি হয়েছিল সেগুলি?