D B Cooper

একাই অপহরণ করেন বিমান, মুক্তিপণ নিয়ে গায়েব হন মাঝ আকাশ থেকে! সমাধান হয়নি কুপার রহস্যের

কে তিনি? কোথা থেকে তিনি এসেছিলেন? কী-ই বা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য? এমন হাজারো প্রশ্ন রেখে মাত্র এক দিনে কয়েক ঘণ্টার উপস্থিতি দিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন ডি বি কুপার।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:৩৬
Share:
০১ ২০

‘ডন কো পকড়না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়’! অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘ডন’ ছবির এই সংলাপ বাস্তব জীবনে বোধ হয় তিনিই একমাত্র সত্যি করে দেখিয়েছেন। তিনি ডি বি কুপার। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-ও ৫২ বছরে যাঁকে খুঁজে পায়নি।

০২ ২০

এখনও ইন্টারনেটে তাঁর নামে সার্চ দিয়ে খোঁজেন বা জানার চেষ্টা করেন বহু মানুষ। কে তিনি? কোথা থেকে তিনি এসেছিলেন? কী-ই বা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য? এমন হাজারো প্রশ্ন রেখে মাত্র এক দিনে কয়েক ঘণ্টার উপস্থিতি দিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন ডি বি কুপার।

Advertisement
০৩ ২০

দিনটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর। অন্য সাধারণ দিনের মতোই নর্থ-ওয়েস্ট ওরিয়েন্ট এয়ালাইন্সের ফ্লাইট-৩০৫ বোয়িং-৭২৭ বিমানটি পোর্টল্যান্ড থেকে সিয়াটেলের উদ্দেশে রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু এই বিমান ওড়া মাত্রই যে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়ে যাবে, তা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।

০৪ ২০

সেই বিমানেই ওঠেন বছর পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। তীক্ষ্ণ চোয়াল, ছিমছাম চেহারা, পরনে স্যুট, চোখে সানগ্লাস। বিমানে একটি সুটকেস নিয়ে উঠেছিলেন তিনি। একঝলকে দেখে মনে হতেই পারে তিনি কোনও ব্যবসায়ী কিংবা কর্পোরেট কর্তা। বিমানে উঠে চুপচাপ নিজের জন্য বরাদ্দ সিটে গিয়ে বসে পড়েন তিনি।

০৫ ২০

ফ্লাইট টেক অফ করার আগে হাসিমুখে এক বিমানসেবিকাকে নিজের কাছে ডাকেন ওই ব্যক্তি। প্রথমে একটি ড্রিঙ্ক অর্ডার করেন তিনি। পরে পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধূমপান করতে শুরু করেন। দুপুর ২টো ১৮ মিনিট নাগাদ বিমান যাত্রা শুরু করে। ওই ব্যক্তির নাম ছিল ড্যান কুপার। ইতিহাস তাঁকে চেনে ডি বি কুপার নামে।

০৬ ২০

বিমান ওড়ার কিছু ক্ষণ পরেই এক বিমানসেবিকাকে ডেকে স্মিত হেসে তাঁর হাতে তুলে দেন একটি খাম। ওই বিমানসেবিকার নাম ছিল ফ্লোরেন্স সফনার। খাম থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে তাতে কী লেখা আছে পড়েন তিনি। আর তা পড়তেই ফ্লোরেন্সের চক্ষু চড়কগাছে! সেই সময় কী করা উচিত ফ্লোরেন্সের মাথায় আসছিল না। এমন সময় শীতল মস্তিষ্কের ওই ব্যক্তি তাঁকে পাশের আসনে বসতে অনুরোধ করেন।

০৭ ২০

কুপারের দেওয়া ছোট্ট কাগজে লেখা ছিল, ‘‘মহাশয়া, আমার কাছে একটি বোমা রয়েছে। আপনি আমার কাছে বসুন।’’ ভয়ে ভয়ে ফ্লোরেন্স তাঁর পাশে বসে পড়েন। ওই ব্যক্তি নিজের সুটকেসটি খুলে দেখান, তাতে আটটি ডিনামাইট এবং একটি ডিটোনেটার রাখা। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে চুপ করে ওই ব্যক্তির কথা শুনছিলেন ফ্লোরেন্স। তত ক্ষণে বিমানসেবিকা বুঝে গিয়েছিলেন বিমান হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছে।

০৮ ২০

ফ্লোরেন্সকে নিজের ৩টি দাবির কথা জানান ওই ব্যক্তি। প্রথম দাবিতে বলা হয়, বিকেল ৫টার মধ্যে তাঁকে নগদ ২ লাখ ডলার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁর জন্য বিমানে দু’টি প্যারাসুট পাঠাতে হবে। তৃতীয়ত, সিয়াটেল বিমানবন্দরে একটি জ্বালানি ভর্তি ট্রাকের বন্দোবস্ত করতে দিতে হবে। ওই ব্যক্তি ফ্লোরেন্সকে বুঝিয়ে দেন, কোনও চালাকির চেষ্টা হলে বিমানে তিনি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবেন।

০৯ ২০

ঘটনাগুলি যখন ঘটছিল, তখন বিমানের সামনে বসে থাকা যাত্রীরা বুঝতেই পারেননি যে, বিমানটি হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছে। তাঁরা জানতেন, ৪৫ মিনিটেই তাঁরা গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন। ওই ব্যক্তির দাবি জেনে বিমানের ক্যাপ্টেনকে গিয়ে পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানান ফ্লোরেন্স।

১০ ২০

এর পর বিমানে থাকা অন্য বিমানসেবিকা টিনা মাকলো একটি ইন্টারকম টেলিফোন নিয়ে কুপারের পাশে বসেন। বিমানচালক এবং কুপারের সঙ্গে কথাবার্তা চলেছিল এই ইন্টারকম টেলিফোনের মাধ্যমে। খবর জানাজানি হতেই আমেরিকার প্রশাসন কুপারের সব দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানায়। কারণ, এর আগে আমেরিকায় কখনও অর্থের জন্য বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটেনি। প্রশাসন ধরেই নিয়েছিল, বিমান এক বার মাটিতে পা রাখলে কুপারকে ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।

১১ ২০

প্রশাসন এবং কুপারের কথাবার্তা চলাকালীন সিয়াটল বিমানবন্দরের এলাকা জুড়ে চক্কর খেয়েছিল বিমানটি। বিমানে থাকা যাত্রীদের বলা হয় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমান অবতরণ সম্ভব হচ্ছে না। সেই সময় সিয়াটলের স্থানীয় ব্যাঙ্ক থেকে নগদ ২ লাখ ডলারের বন্দোবস্ত করা হয়। ওই ডলারের নম্বরও নিজেদের কাছে রাখছিল প্রশাসন। কুপারের দাবি মতো দু’টি প্যারাসুটও পাঠানো হয়।

১২ ২০

৫টা ৪৫ মিনিটে সিয়াটল বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। সঙ্গে সঙ্গেই কুপারের কাছে নগদ অর্থ এবং প্যারসুট পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই সময় বিমানে জ্বালানিও ভরা হয়। এই অবস্থায় কুপার মুক্তি দেন ৩৫ যাত্রী এবং ২ জন বিমানকর্মীকে। কিন্তু বিমানচালক এবং দু’জন বিমানকর্মীকে বিমানে রেখে আবারও বিমার ওড়ানোর নির্দেশ দেন কুপার। সঙ্গে জানিয়ে দেন, তাঁর নির্দেশ মতোই বিমান চালাতে হবে। মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে বিমান নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।

১৩ ২০

কিন্তু জ্বালানির অপ্রতুলতায় মেক্সিকো সিটি যাওয়া সম্ভব ছিল না। সেই সময় বিমান কতটা উচ্চতায় কত গতিবেগে চলবে, সবই ঠিক করে দিচ্ছিলেন কুপার। রিনো অথবা ফিনিক্সে আবারও জ্বালানি ভরার জন্য বিমানচালককে নির্দেশ দেন তিনি। রিনোতে বিমান নামানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এই সময় দু’টি যুদ্ধবিমানকে ওই বিমানটির পিছনে ধাওয়া করতে পাঠায় আমেরিকা।

১৪ ২০

এক সময় বিমানসেবিকা টিনাকে ককপিটে যাওয়ার নির্দেশ দেন কুপার। রাতের অন্ধকারে বিমানটি নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিমানচালক। এই সময় ককপিটের দরজা খোলার সময় টিনা দেখেন কুপার নিজের কোমরে কিছু একটা বাঁধছেন। এর পর দরজা বন্ধ করে ককপিটে ঢুকে যান টিনা। তাঁদের দাবি, ওই সময় কেউ না থাকার সুযোগ নিয়ে বিমানের সিঁড়ি খুলে উড়ন্ত বিমান থেকেই প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দেন কুপার। তার পর আর কেউ তাঁর হদিস পায়নি। গত ৫২ বছর ধরে তিনি বেপাত্তা।

১৫ ২০

তিন ঘণ্টা পর বিমান রিনো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কুপারের কোনও চিহ্ন পাননি গোয়েন্দারা। তবে যে দু’টি প্যারাসুট তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, তার একটি মিলেছিল। সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল তাঁর টাই এবং আটটি সিগারেট। পাওয়া গিয়েছিল তাঁর স্বাক্ষর করা বিমানের বোর্ডিং পাসটিও।

১৬ ২০

বিমানকর্মী এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে কুপারের একটি স্কেচ তৈরি করা হয়। তাঁর ছবির সঙ্গে তাঁকে দেওয়া ডলারের নম্বর সর্বজনীন করেও লাভের লাভ হয়নি। দেওয়া হয়েছিল পুরস্কারের প্রলোভনও। তাতেও সমাধান হয়নি বিমান অপহরণ রহস্যের। কুপার কোথায় ঝাঁপ দিয়েছিল, তা-ও জেনেছিলেন গোয়েন্দারা। আমেরিকার একটি পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এলাকায় তাঁর অবতরণের কথা জেনেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি কুপারের খোঁজ।

১৭ ২০

তাঁকে দেওয়া ডলার খরচ করলেই তিনি ধরা পড়ে যাবেন, এমন ভাবনাও ছিল গোয়েন্দাদের। কিন্তু এখানেও ব্যর্থতাই হাতে এসেছিল।

১৮ ২০

১৯৮০ সালে দক্ষিণ ওয়াশিংটনের কলম্বিয়া নদীর ধারে একটি বাচ্চা খেলা করছিল। সেই বাচ্চাটি বালি খুঁড়তে খুঁড়তে তিনটি ডলারের বান্ডিল পায়। ছেলের হাতে এত ডলার দেখে ঘাবড়ে যান তাঁর বাবা-মা।

১৯ ২০

মোট ৫,৮০০ ডলার পাওয়া গিয়েছিল ওই এলাকা থেকে। বাচ্চাটির মা-বাবা ওই ডলারের বান্ডিল তুলে দেন এফবিআইয়ের হাতে। তাঁরা তদন্ত করে জানতে পারেন, এই ডলারগুলি ৯ বছর আগে দেওয়া হয়েছিল ডি বি কুপারকে। কুপার যে এলাকায় ঝাঁপ দিয়ে নেমে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে এই এলাকাটি ছিল ২৭ কিমি দুরে। এই ডলারগুলি পাওয়া গেলেও, বাকি অর্থ আজও পাওয়া যায়নি।

২০ ২০

আমেরিকার গোয়েন্দাদের মতে, ডি বি কুপার কোনও সন্ত্রাসবাদী দলের সদস্যও হতে পারেন। কারণ তাঁকে যে প্যারাসুটগুলি দেওয়া হয়েছিল, তার একটি ছিল সেনাবাহিনীর। আর একটি ছিল সাধারণ মানের। যে প্যারাসুটটি চেপে কুপার বিমান থেকে পালিয়েছিলেন, সেটি ছিল সেনাবাহিনীর। দক্ষ প্রশিক্ষণ না থাকলে ওই ধরনের প্যারাসুট চালানো সম্ভব নয়। তবে এত কিছু করেও পাওয়া যায়নি ডি বি কুপারকে। আজও পৃথিবীর কাছে রহস্য হয়ে আছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement