ঝলমলে বৈঠক। তারকা নেতাদের সমাবেশ। বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র তৃতীয় বৈঠক নজর রেখেছে গোটা দেশ। কে কী বলছেন, কে কার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। কে কাকে জড়িয়ে ধরছেন— এ সব কিছুই দেখা হচ্ছে খুঁটিয়ে।
কিছু দিন আগেই হয়তো রাজ্যের কোনও একটি ইস্যুতে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তোপ দেগেছে দু’টি দল। জোর বাদানুবাদ হয়েছে দুই দলের আঞ্চলিক প্রধানের। ‘ইন্ডিয়া’র দৌলতে এখন তারা এক পক্ষ। দু’দলের প্রধান কে কী ভাবে হাসছেv একে অপরের দিকে তাকিয়ে?
শুক্রবার ছিল বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র তৃতীয় বৈঠকের দ্বিতীয় দিন। পটনা, বেঙ্গালুরুর পর ‘ইন্ডিয়া’র তৃতীয় বৈঠক হচ্ছে মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বইয়ে।
মুম্বইয়ের সান্তাক্রুজ় এলাকার হোটেল গ্র্যান্ড হায়াতে বিজেপি-বিরোধী জোটের ওই বৈঠক শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই।
বৈঠকে যোগ দেন ২৮টি বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা। কথা ছিল, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র প্রতীক প্রকাশ হতে পারে শুক্রবারের বৈঠকে। পরে অবশ্য জানা যায়, প্রতীক নিয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নয়। আপাতত সমন্বয় সাধনের দিকেই গুরুত্ব দিতে চান জোটের সদস্যরা। মমতা বলেন, ‘‘ভারতের যাতে সবচেয়ে ভাল হয়, তার জন্যই লড়াই ‘ইন্ডিয়া’র।’’
তবে সেই সমন্বয় সাধনের ফাঁকেই ধরা পড়ল এক সময়ের বিরোধীদের সেই সব বিরল মুহূর্ত।
বৃহস্পতিবার থেকে বৈঠক শুরুর কথা থাকলেও বুধবার সকাল থেকেই হোটেলে একে একে আসতে দেখা যায় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে, সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীকে।
তৃণমূলের তরফে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েন।
বৈঠকস্থলে দেখা যায় সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সপুত্র লালুপ্রসাদ যাদব, সপুত্র শিবসেনা (উদ্ধব) নেতা উদ্ধব ঠাকরেকেও।
আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল, আপের পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মানও বুধবারই এসে পৌঁছেছিলেন মুম্বইয়ে।
বৈঠকের শুরুতে উদ্ধব এবং নীতীশ কুমারদের সঙ্গে কথা বলেন মমতা। তেজস্বী যাদবকেও দেখা যায় মমতার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে প্রণাম করতে।
মুম্বইয়ের বৈঠকে রাহুল গান্ধীকে দেখা যায় মমতার পাশে এসে বসতে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল বেঙ্গালুরুর বৈঠকেও।
মুম্বইয়ে বৈঠকের আগে দিল্লিতে রাহুল এবং অভিষেক একপ্রস্ত বৈঠক সেরে এসেছেন। রাজনীতির হাওয়ায় যে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, তাতে অনুমান, লোকসভা ভোটে রাজ্য স্তরে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম কী ভাবে নিজেদের মধ্যে আসন ভাগ করে নেবে, তা নিয়েই কথা হয়েছে সেখানে।
সেই সাক্ষাতের পর মুম্বইয়ের বৈঠকে মমতার পাশে রাহুলের আসন চয়নকে ইতিবাচক লক্ষণ বলে মনে করছেন রাজনীতির নজরদারেরা।
অভিষেক মুম্বইয়ে আসার আগে রাহুলের পাশাপাশি দিল্লিতে আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সঙ্গেও বৈঠক করেছিলেন। পরে মুম্বইয়ের বৈঠকে আপ প্রধান আসন সমঝোতার বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে ঠিক করে ফেলার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘‘৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এর একটি পদ্ধতি ঠিক করে ফেলা হোক।’’
কেজরীর সেই প্রস্তাব নিয়ে সিদ্ধান্ত না হলেও শুক্রবারের বৈঠকে পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের একটি কমিটি গঠন করেছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে, সেই ১৩ জনের সমন্বয় কমিটির সদস্যরা হলেন শরদ পওয়ার (এনসিপি), কেসি বেণুগোপাল (কংগ্রেস), এমকে স্ট্যালিন (ডিএমকে), অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (তৃণমূল), তেজস্বী যাদব (আরজেডি), হেমন্ত সোরেন (জেএমএম), মেহবুবা মুফতি (পিডিপি), ওমর আবদুল্লা (ন্যাশনাল কনফারেন্স), সঞ্জয় রাউত (শিবসেনা-উদ্ধব), লালন সিংহ (জেডিইউ), জাভেদ আলি খান (সমাজবাদী পার্টি), ডি রাজা (সিপিআই) এবং রাঘব চড্ডা (আপ)।
২৩ জুন পটনায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশের আহ্বানে ১৭টি বিরোধী দলের প্রথম বৈঠক হয়েছিল। তার পর থেকে অনেকটাই এগিয়েছে বিরোধীদের জোট ‘ইন্ডিয়া’।
গত ১৭-১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে ২৬টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘ইন্ডিয়া’। শুক্রবার ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে যোগ দিয়েছে ২৮টি বিরোধী দল। জোটের আনুষ্ঠানিক স্লোগানও ঘোষিত হয়েছে সেখানে— ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’।
বৈঠক চলাকালীন, তার আগে এবং পরে এমনই কিছু বেঁধে বেঁধে থাকার তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ধরা পড়েছে।
শুক্রবারের বৈঠকে আসনসজ্জার দিকে এক নজর দেওয়া যাক। দেখা যায় সীতারাম ইয়েচুরির পাশেই বসেছেন রাহুল গান্ধী। তার অপর পাশে মমতা। তার পর নীতীশ কুমার, মল্লিকার্জুন খড়্গে, উদ্ধব ঠাকরে, শরদ পাওয়ার, সনিয়া গান্ধী, লালুপ্রসাদ যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, এম কে স্তালিন, তার পরে অখিলেশ যাদব। ওই সারির শেষ প্রান্তে ছিলেন ওমর আবদুল্লা।
পটনার বৈঠকে ইয়েচুরি আর মমতার হেসে কথা বলার ছবিটি আলোচনায় উঠে এসেছিল।
বাংলায় আসন্ন ধূপগুড়ি বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম-কংগ্রেসের জোট। শুক্রবার সেখানে জোড়া প্রচার সভাও করেন দু’দলের প্রধান মহম্মদ সেলিম এবং অধীর। একযোগে আক্রমণ করেন মমতাকে। ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে এ বারও সিপিএম এবং তৃণমূলকে দেখা গেল সৌজন্য বিনিময় করতে। সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরির সঙ্গে মুম্বইয়ের বৈঠকে সৌজন্যমূলক হাসি বিনিময় করতে দেখা গেল মমতাকে। ছবিটি পোস্ট করে বিরোধী জোটকে কটাক্ষও করেছেন বাংলার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
ঠিক তেমনই বাংলায় কয়েক মাস আগে পঞ্চায়েত ভোট থেকে নিয়োগ মামলা— নানা বিষয়ে কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে শাসকদল তৃণমূলের নানা বাদানুবাদ হয়েছে। তারও আগে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভোটের সময় প্রকাশ্যেই রাহুল গান্ধীকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে এবং তৃণমূল নেত্রীকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছিল।
মাঝে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়ার সঙ্গে মমতার সম্পর্কেও কিছুটা শীতলতা চোখে পড়েছিল রাজনীতির কারবারিদের একাংশের। মুম্বইয়ের বৈঠকে সেই শীতলতা অবশ্য নজরে পড়ল না। শুক্রবার বৈঠকের পর ছবি তোলার সময় পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন সনিয়া।
সেই সময়ে দু’জনকে একগাল হেসে কথা বলতেও দেখা গেল। তবে কি জোটের কল্যাণে বিরোধীদের বরফ সত্যিই গলছে? মহারাষ্ট্রের বৈঠক অন্তত তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।