রাজস্থানের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম। শৈশবে হারান মাকে। পড়াশোনা ছেড়ে কিশোরী বয়সে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু চোখে ছিল অফুরান স্বপ্ন। ছিল উপার্জন করে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার খিদে। ৩৫ বছরের সেই তরুণী রুমা দেবীর ফ্যাশন সরণি পর্যন্ত পৌঁছনোর রাস্তা খুব একটা সহজ ছিল না।
১৯৮৮ সালের ১৬ নভেম্বর রাজস্থানের বাঢ়মের গ্রামে জন্ম রুমার। রুমার যখন দু’বছর বয়স, তখন তাঁর মা মারা যান। রুমার মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু আর্থিক অভাবের মধ্যে রুমাকে তাঁর মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মামাবাড়ি যাওয়ার পর স্কুলে ভর্তি করানো হয় রুমাকে। কিন্তু অর্থাভাবের কারণে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় তাঁকে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর স্কুল ছেড়ে দেন তিনি। পড়াশোনা ছেড়ে ঘরের কাজকর্ম শিখতে শুরু করেন রুমা।
মামাবাড়ির যাবতীয় কাজ একা হাতে সামলাতে শুরু করেন রুমা। জল ভরার জন্য ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হত তাঁকে। কাজ থেকে অবসর পেলে দিদার কাছে কাপড় বোনা শিখতেন রুমা।
২০০৫ সালে ১৭ বছর বয়সে রুমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর পুত্রসন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু জন্মের দু’দিনের মধ্যেই তাঁর সদ্যোজাত সন্তান মারা যায়। শোকে কাতর হয়ে পড়েন রুমা। নিজেকে সামলে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি।
সংসার সামলানোর পাশাপাশি উপার্জন করার কথা ভাবতে শুরু করেন রুমা। নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করবেন বলে স্বপ্ন বুনতে আরম্ভ করেন তিনি। বিয়ের আগে দিদার কাছে কাপড় বোনার কাজ শিখেছিলেন। স্বপ্ন দেখলেন তা নিয়েই নিজের কেরিয়ার গড়ে তোলার।
রুমা শুধুমাত্র নিজের জন্য স্বপ্ন দেখেননি। রাজস্থানে তাঁর মতো এমন বহু মহিলা রয়েছেন যাঁরা রোজগার করতে চান। তাঁদের সঙ্গে নিজের স্বপ্ন এক সুতোয় বুনে এগিয়ে যান রুমা।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন রুমা। রাজস্থানের সেই গ্রামের আরও ১০ জন মহিলা রুমার সঙ্গে একই পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হাতে তেমন পুঁজি নেই। পুঁজি ছাড়া ব্যবসা শুরু হবে কী করে?
রুমার সঙ্গে যে ১০ জন মহিলা ব্যবসা শুরু করবেন বলে এগিয়ে আসেন তাঁরা সকলে ১০০ টাকা দিয়ে মোট এক হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেন। সেই টাকা খরচ করে কাপড়ের থান, সুতো থেকে শুরু করে একটি পুরনো সেলাইয়ের মেশিন কেনেন তাঁরা।
২০০৬ সালে ১০ জন মহিলাকে নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী চালু করেন রুমা। ব্যাগ এবং কুশন তৈরি করে ধীরে ধীরে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে থাকেন তিনি। হাতের কাজে মুগ্ধ হয়ে গ্রামের বহু বাসিন্দাই রুমাদের কাছ থেকে কেনাকাটা আরম্ভ করেন। রাজস্থানের গ্রামে গ্রামে খুব কম সময়ের মধ্যে পরিচিতি তৈরি হয়ে যায় রুমার।
২০০৮ সালে রাজস্থানের একটি স্থানীয় সংগঠনের সদস্য হিসাবে যুক্ত হন রুমা। দু’বছরের মধ্যে সেই সংগঠনের সভাপতি হন তিনি। রাজস্থানের গণ্ডি ছেড়ে তিনি পাড়ি দেন রাজধানীর উদ্দেশে।
২০১০ সালে দিল্লিতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন রুমা। রাজস্থানের লোককথা, গ্রামীণ সংস্কৃতি কাপড়ে যে নিপুণ ভাবে রুমা ফুটিয়ে তোলেন, তার সাক্ষী হন দিল্লির বাসিন্দারা। চতুর্দিকে নামডাক ছড়িয়ে পড়ে রুমার।
২০১৬ সালে ফ্যাশন শোয়ের আয়োজন করেন রুমা। ফ্যাশন সরণিতে সে দিন ভারতের প্রথম সারির পোশাকশিল্পীদের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেন তিনি।
রুমা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, অমিতাভ বচ্চনের সঞ্চালনায় ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ পান। এমনকি জনপ্রিয় রিয়্যালিটি শোয়ে নারী দিবসে অতিথি হিসাবে ডাক পান রুমা।
২০১৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছ থেকে ‘নারীশক্তি পুরস্কার ২০১৮’-য় পুরস্কৃত হন রুমা। জয়পুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
২০২০ সালে ১৭তম বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির তরফে। সেই সম্মেলনে বক্তার আসনে দেখা যায় রুমাকে।
কুশন এবং ব্যাগ তৈরি করে এক হাজার টাকা দিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন রুমা, বর্তমানে তার সাফল্য আকাশচুম্বী। ঘর সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে গলায় জড়ানোর স্কার্ফ, নারী-পুরুষের জন্য জামাকাপড় নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে বিক্রি করা শুরু করছেন রুমা।
১০ জন নারীকে নিয়ে যে ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলেন, এখন তা আকারে বেড়েছে কয়েক গুণ। বর্তমানে ৩০ হাজারেরও বেশি মহিলা রুমার সংস্থায় কাজ করেন।
অনলাইন মাধ্যমে কাপড় বোনার কাজ শেখানোর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন রুমা। প্রশিক্ষণ শেষ হলে শংসাপত্রও দেওয়া হয়। বর্তমানে সমাজমাধ্যমে জনপ্রিয় মুখ হয়ে উঠেছেন রুমা। ইতিমধ্যে ইনস্টাগ্রামের পাতায় অনুগামীর সংখ্যা দু’লক্ষের গণ্ডি পার করে ফেলেছেন পোশাকশিল্পী রুমা দেবী।